১৯৪৪ সালের শীতকালে পশ্চিম নেদারল্যান্ড ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছিল। হিটলার অবরোধ দিয়ে সে পথে খাবার ও জ্বালানির প্রবেশ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। খাদ্যের অভাবে মানুষ ভিক্ষা করেছে, কখনো বা ঘাস ও টিউলিপ কন্দ খেয়ে থেকেছে। বেশির ভাগ মানুষই দিনে ৬০০ ক্যালরির বেশি খেতে পারেননি, যেখানে একজন পূর্ণ বয়স্ক লোকের প্রায় ২০০০ ক্যালরি খাবার প্রয়োজন। দুর্ভিক্ষের কারণে ২০ হাজার লোক মারা গিয়েছিল সেবার।
ইতিহাসের এই বিপর্যয়টি পরবর্তীতে গবেষকদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় আবিষ্কারের সুযোগ করে দিয়েছিল। যেহেতু দুর্ভিক্ষটি একটি ধনী সমাজে হয়েছিল, তাই সাময়িক অপুষ্টি একজন মানুষের এবং তার সন্তানদের সুস্বাস্থ্যে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য এটি একটি উৎকৃষ্ট প্লট তৈরি করেছিল।
১৯৯০ সালে ডাচ মেডিক্যাল রিপোর্ট নিয়ে কাজ করার সময় যুক্তরাষ্ট্র এবং নেদারল্যান্ডের এপিডেমিওলজিস্টরা লক্ষ করলেন যে, কয়েক হাজার বাচ্চা, যারা দুর্ভিক্ষের সময় মায়ের গর্ভে ছিল তাদের জন্ম-ওজন খুব কম ছিল। এটা অবশ্য তাদের অবাক করেনি। যা তাদের অবাক করেছিল তা হলো, পরবর্তী জীবনে এদের প্রায় সকলেই হৃদরোগ, স্থূলতা ও ডায়াবেটিসে ভুগেছে। এই ঘটনাটিই বিজ্ঞানীদের প্রথম চোখ খুলে দিয়েছিল যে, বাবা-মায়ের পুষ্টি উপাদান গ্রহণের ধরন তার সন্তানদের ওপর কয়েক দশক পরেও প্রভাব ফেলতে পারে। অর্থাৎ সন্তান ধারণের সময় আপনি এবং আপনার জীবনসঙ্গীর পুষ্টিগত অবস্থার প্রভাব আপনার সন্তানের বৃদ্ধ বয়সেও প্রকাশ পায়।
কিন্তু কীভাবে? তখন তো আপনার সন্তান জন্মায়নি পর্যন্ত। আর গর্ভধারণের সময় মায়ের অপুষ্টি তার সন্তানের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। কিন্তু বাবা তো গর্ভধারণ করেন না। তার পুষ্টিগত অবস্থাও কেন সন্তানের স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলে? আর গর্ভে থাকা অবস্থায় অপুষ্টিতে থাকলেও যদি জন্মের পর তার পুষ্টি ভালোভাবে পূরণ করা হয় তাহলে তো নেতিবাচক প্রভাব থাকার কথা না। তারপরও কেন সন্তান নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে?
আমরা জানি, বাবার শরীরের ৫০% ক্রোমোজোম নিয়ে একটি শুক্রাণু মায়ের শরীরের ৫০% ক্রোমোজোম-সংবলিত ডিম্বাণুর সাথে মিলিত হয়ে একটি মাত্র পূর্ণাঙ্গ কোষ তৈরি করে। ৩০ ঘণ্টা পর এই একটি কোষ সমভাবে দ্বিখ-িত হয়ে দুটি কোষে পরিণত হয় আর তার কয়েক ঘণ্টা পর ৪টি কোষে পরিণত হয়। এভাবে ৮টি, ১৬টি, ৩২টি, ৬৪টি এবং আরো। যার অর্থ হচ্ছে প্রত্যেকটি কোষের ডিএনএ বা জেনেটিক উপাদান হুবহু এক।
এই জেনেটিক উপাদানগুলোতে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ তৈরির ইনফরমেশন রয়েছে। একে একটি কুক বুক বলা যেতে পারে, যেখানে মানবদেহের যেকোনো অঙ্গের কোষকলা, এনজাইম, হরমোন বা অন্যান্য উপাদান তৈরির রেসিপি দেয়া আছে। আমাদের কোষের হাতে কিছু অস্ত্র আছে, যা দিয়ে এটি ৩ বিলিয়ন বেজ পেয়ারের কু-লী পাকানো একটি লম্বা ডিএনএ মলিকিউল থেকে খুঁজে খুঁজে শুধু সেই অংশটিকে কাজে লাগায়, যা তার প্রয়োজন। যেমন অগ্ন্যাশয়ের কোষ ইনসুলিন তৈরির রেসিপিটি খুঁজে বের করে ইনসুলিন তৈরি করে, পাকস্থলীর কোষ গ্যাস্ট্রিক জুস আর অন্যান্য অঙ্গের কোষ এমন অন্য কিছু।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন কোনো নির্দিষ্ট একটি অস্ত্র নয়, বরং অনেকগুলো অস্ত্রের বা পদ্ধতির সমন্বয়ে কোষ এই কাজগুলো করে। এই পদ্ধতিগুলোকে একত্রে এপিজিনোম বলে। এপি অর্থ উপরে। অর্থাৎ যে তথ্যগুলো জিনোমের ওপর দিয়ে লেখা থাকে তাদের একত্রে এপিজিনোম বলে আর এখানেই সেই নির্দেশনা আছে যে কীভাবে কোষ ডিএনএকে প্রকাশ করবে।
ডিএনএ’র যে অংশটা ক্রোমোজোমের মধ্যে আঁটসাঁটভাবে আবদ্ধ থাকে, প্রোটিন তৈরির যন্ত্রগুলো তাদের খুঁজে পায় না বলে সেগুলো প্রকাশিত হতে পারে না। কিন্তু কোষের হাতে এমন কিছু পদ্ধতি আছে, যা দিয়ে প্রয়োজনীয় অংশের ডিএনএকে কু-লীমুক্ত করা যায়। আবার অনেক সময় বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে একটি নির্দিষ্ট ডিএনএ অংশকে ঢেকে ফেলে তার প্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করা যায়। এসবই এপিজিনোমের অংশ। তবে সবথেকে বেশি ব্যবহৃত হয় যে পদ্ধতিটি তা হচ্ছে মিথাইলেশন।
আমাদের ডিএনএজুড়ে কমপক্ষে ৩০ মিলিয়ন পয়েন্ট আছে, যেখানে মিথাইলেশন হতে পারে। এই পয়েন্টগুলোতে মিথাইলেশন হলে প্রোটিন তৈরির যন্ত্রগুলো সেই পয়েন্টগুলোতে জোড়া লাগতে পারে না বলে প্রোটিন তৈরি হতে পারে না। যার কারণে ওই জিনটি সাইলেন্ট হয়ে যায়। একটি স্বাভাবিক স্বাস্থ্যকর খাবার খেলে মিথাইলেশন কোনো সমস্যা সৃষ্টি করে না। কিন্তু যখন খাবার থেকে মিথাইল গ্রুপ সরবরাহকারী ফোলেটকে সরিয়ে নেয়া হয় তখন গ-গোলটা বাধে। মিথাইল গ্রুপের অভাবে যে প্রোটিনটি তৈরি হওয়ার দরকার নেই সেটিও তৈরি হয়, যা একপর্যায়ে কোষে বিশৃঙ্খলতার সৃষ্টি করে।
আবার অতিরিক্ত ফোলেট হয়তো কোনো প্রয়োজনীয় প্রোটিন উৎপাদন বন্ধ করে দিতে পারে। কোনো কারণে যদি মিথাইলেশন প্রক্রিয়াটি নষ্ট হয়ে যায় তবে কোন প্রোটিন কখন তৈরি হবে সেই ইনফরমেশনগুলো নষ্ট হয়ে যায়। এতে ভুল সময়ে ভুল প্রোটিন তৈরি হয় আর প্রয়োজনের সময় প্রয়োজনীয় প্রোটিনটি তৈরি হয় না। এই অবস্থার কারণে স্থূলতা থেকে হৃদরোগ এমনকি ক্যানসারও সৃষ্টি হতে পারে।
মিথাইলেশনের একটি সহজবোধ্য উদাহরণ হচ্ছে রানি মৌমাছি। কর্মী মৌমাছি ও রানি মৌমাছির জেনেটিক উপাদান হুবহু এক। কিন্তু কর্মী মৌমাছি সন্তান উৎপাদন করতে পারে না, অন্যদিকে রানি মৌমাছি দিনে ২০০০টি পর্যন্ত ডিম দেয়। আবার একটি রানি মৌমাছি একটি কর্মী মৌমাছি অপেক্ষা ৪০ গুণ বেশি সময় বাঁচে। একই জেনেটিক উপাদান নিয়ে কীভাবে তাদের বৈশিষ্ট্যগুলো এত ভিন্ন হতে পারে? এটা সম্ভব হয় মিথাইলেশনের কারণে। সাধারণত কর্মী মৌমাছিরা যে খাবার খায় তাতে ডিম্বাশয় তৈরিতে যে প্রোটিন প্রয়োজন সেসব প্রোটিনের জিনে বা ডিএনএ অণুতে মিথাইলেশন হয় এবং সেগুলো প্রকাশ পায় না। তার মানে এই দাঁড়াল যে, ডিম্বাশয় তৈরি হতে পারে না। অন্যদিকে রানি মৌমাছিকে শুধু রয়েল জেলি খাওয়ানো হয়, যেখানে কোনো মিথাইল গ্রুপ থাকে না। এই রয়েল জেলি ওই জিনগুলোতে মিথাইলেশন হতে দেয় না বলে প্রোটিনগুলো প্রকাশ পায় এবং এদের ডিম্বাশয় তৈরি হয়। অর্থাৎ এপিজিনোমের কারণে কর্মী ও রানি মৌমাছিতে রাত ও দিনের তফাৎ তৈরি হয়, যদিও তাদের জিনোমে কোনো পার্থক্য নেই।
নিউট্রিশন এবং ক্যানসারের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজতে গিয়ে টাফ্ট ইউনিভার্সিটির গবেষক জিমি কট একই জেনেটিক উপাদানবিশিষ্ট একগুচ্ছ ইঁদুরের ভ্রƒণকে দুই ভাগ করে আলাদা দুটি মায়ের গর্ভে প্রতিস্থাপন করেছিলেন। এরপর তিনি একটি মাকে মিথাইল গ্রুপ-সমৃদ্ধ স্বাভাবিক খাবার দেন এবং অপর মাকে মিথাইল গ্রুপ খুব কম আছে এমন খাবার দেন। দেখা গেল, যে মা’টি মিথাইল গ্রুপ-সমৃদ্ধ খাবার খেয়েছিল তার বাচ্চাগুলোর মধ্যে ইনটেস্টাইনাল ক্যানসার হওয়ার সংখ্যা যে মা’টি মিথাইল গ্রুপ-সমৃদ্ধ খাবার খায়নি তার বাচ্চাদের থেকে অনেক কম। জিমি কট এবার মিথাইল গ্রুপ-সমৃদ্ধ খাবার না খাওয়া মায়ের বাচ্চাদের ডিএনএ টেস্ট করলেন এবং ভীষণ চমকপ্রদ একটি বিষয় দেখতে পেলেন। তিনি দেখলেন, এদের ডিএনএ মলিকিউলে টিউমারকে দমন করে রাখে এমন একটি জিন মিথাইলেশনের কারণে প্রকাশিত হতে পারে না। ফলে টিউমার সৃষ্টি হতে বাধা থাকে না এবং সেই টিউমার পরবর্তীতে ক্যানসারে রূপ নেয়।
একইভাবে বাবা ইঁদুরের ওপর এই পরীক্ষাটি করে তিনি দেখেন পুরুষ ইঁদুরের স্পার্ম তৈরির সময় খুব বেশি মিথাইল গ্রুপ-যুক্ত খাবার এবং খুব কম মিথাইল গ্রুপ-যুক্ত খাবার তার মেয়ে সন্তাদের ইনটেস্টাইনে টিউমার এবং রক্তে কলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি করে। অপরদিকে স্বাভাবিক মিথাইল গ্রুপ-যুক্ত খাবার যেসব বাবা ইঁদুর খেয়েছে তাদের মেয়ে সন্তানদের মধ্যে এর হার অনেক কম ছিল। এ পরীক্ষাটি নির্দেশ করে যে মায়ের মতো বাবার পুষ্টি গ্রহণও বিশেষ করে তার স্পার্ম তৈরির সময় তার খাবারের ধরন তার সন্তানদের স্বাস্থ্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে এবং অতি-মিথাইল ও খুবই কম মিথাইল দুটিই নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
গবেষকরা মানুষেও এমন ফলাফল দেখেছেন। তবে ছেলেদের ক্ষেত্রে তার ১১-১২ বয়সের খাদ্যাভ্যাসটা খুবই জোরালো প্রভাব ফেলে। তাই পরবর্তী প্রজন্মের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ছেলে ও মেয়ে উভয়েরই সঠিক খাদ্যাভ্যাস তৈরির কোনো বিকল্প নেই।