বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুযায়ী ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ১৯৮০ সালে ১০৮ মিলিয়ন থেকে বেড়ে ২০১৪ সালে ৪২২ মিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। যার মানে হচ্ছে পৃথিবীতে প্রতি ১১ জন মানুষের মধ্যে একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ডায়াবেটিসের প্রাদুর্ভাব উন্নত বিশ্বের গণ্ডি পেরিয়ে মধ্য ও নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশগুলোতে বিপজ্জনক হারে বেড়ে চলেছে। মনে করা হচ্ছে ২০৪০ সাল নাগাদ ৬৪২ মিলিয়ন মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবে। আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে, যাদের ডায়াবেটিস হয়েছে তাদের ৪৬% জানেনই না যে তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। বলার সুবিধার্থে ডায়াবেটিসকে রোগ বলা হলেও ডায়াবেটিস আসলে কোনো একটি রোগ নয়, বরং কতগুলো ক্রনিক রোগের সমাহার। সাধারণত সেই রোগগুলোকে ক্রনিক বলা হয়, যে রোগগুলো দীর্ঘ সময় (তিন মাসের বেশি) ধরে বর্তমান থাকে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই রোগগুলোর সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব হয় না। জীবনযাপনে পরিবর্তন এনে এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের সহায়তায় সুস্থ জীবনযাপন সম্ভব হয়। তবে ডায়াবেটিস বিশেষ করে টাইপ-২ ডায়াবেটিস আদৌ ক্রনিক রোগ কি না তা নিয়ে বেশ জোরেশোরে গুঞ্জন শুরু হয়েছে।
ডায়াবেটিস কী?
আমরা জানি যে, আমাদের শরীর গ্রহণকৃত খাবার হজম ও শোষণপূর্বক শরীরের সমস্ত কোষের প্রয়োজনীয় শক্তির যোগান দেয়। এই সিস্টেমটি ঠিকমতো কাজ করতে না পারার ওপর ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হওয়া নির্ভর করে। যখন আমরা কোনো খাবার খাই তখন খাবারের মধ্যে বিদ্যমান কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা পাকস্থলীতে পৌঁছে ডাইজেস্টিভ সিস্টেম দ্বারা ভেঙে গ্লুকোজে পরিণত হয়।
আমাদের শরীরে গ্লুকোজ প্রয়োজন কারণ এটি আমাদের শক্তি দেয়। এই গ্লুকোজ তখন পাকস্থলীর প্রাচীর দ্বারা শোষিত হয়ে রক্তস্রোতে গিয়ে মিশে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রাকে বাড়িয়ে দেয়। এর প্রতিক্রিয়ায় পাকস্থলীর নিচে অবস্থিত অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন নামক হরমোন নিঃসৃত হয়, যা শরীরকে খাবার থেকে শক্তি উৎপাদন করতে সাহায্য করে। এই ইনসুলিন এবং গ্লুকোজ তখন রক্তস্রোতের মাধ্যমে আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষে পৌঁছে যায়, যেখানে প্রতিনিয়ত শক্তি প্রয়োজন। ইনসুলিন গ্লুকোজকে কোষের মধ্যে প্রবেশ করতে সাহায্য করে।
এখানে ইনসুলিন অনেকটা চাবির মতো কাজ করে, যা গ্লুকোজের জন্য কোষের দরজা খুলে দেয়, অর্থাৎ ইনসুলিন ছাড়া গ্লুকোজ কোষের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে না। গ্লুকোজ কোষে প্রবেশ করে শক্তি উৎপাদন করে কোষের শক্তির চাহিদা পূরণ করে এবং অতিরিক্ত শক্তি সঞ্চয় করে রেখে দেয় ভবিষ্যতে ব্যবহার করার জন
এভাবে ইনসুলিনের সহায়তায় রক্তের গ্লুকোজ কোষে চলে যাবার কারণে রক্তস্রোতে গ্লুকোজের মাত্রা কমে আসে। এর প্রতিক্রিয়ায় অগ্ন্যাশয় থেকে গ্লুকাগন নামে আরেকটি হরমোন নিঃসৃত হয়, যা যকৃতে সঞ্চয়কৃত গ্লুকোজ অবমুক্তের মাধ্যমে রক্তস্রোতে গ্লুকোজের মাত্রা আবার বাড়িয়ে দেয়। তার প্রতিক্রিয়ায় আবার ইনসুলিন নিঃসৃত হবে এবং সেই ইনসুলিন আবারও রক্তস্রোতের মধ্য দিয়ে সেই গ্লুকোজকে দেহকোষে পৌঁছে দেবে।
শরীর সবচেয়ে ভালো কাজ করে যখন রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় (৭০-১০০ মিগ্রা.) থাকে। দেহে গ্লুকোজের মাত্রা খুব বেশি বেড়ে যাক বা খুব বেশি কমে যাক, তা শরীর কখনো চায় না। সাধারণত দেহে একটি পরিক্রমা আছে, যার মাধ্যমে গ্লুকোজের মাত্রা ও ইনসুলিনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকে আর এটি অর্জিত হয় গ্রহণকৃত খাবার, অগ্ন্যাশয় এবং লিভারের সমন্বিত ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে। যাই হোক, কিছু মানুষের ক্ষেত্রে এই সিস্টেমটি কাজ করে না। ফলশ্রুতিতে, তাদের ডায়াবেটিস দেখা দেয়।
ডায়াবেটিস কত প্রকার?
সাধারণত দুই ধরনের ডায়াবেটিস আছে।
* টাইপ-১ ডায়াবেটিস এবং
* টাইপ-২ ডায়াবেটিস।
টাইপ-১ ডায়াবেটিস
এ ক্ষেত্রে শরীর মোটেও কোনো ইনসুলিন উৎপাদন করে না। মূলত এটি একটি স্বয়ংক্রিয় প্রতিক্রিয়া থেকে হয়, যেখানে শরীরের নিজস্ব প্রতিরক্ষা-ব্যবস্থা অগ্ন্যাশয়ের ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষকে ধ্বংস করে। আমরা এখনো পরিষ্কারভাবে জানি না ঠিক কী কারণে কারো কারো ক্ষেত্রে এমনটা ঘটে আবার অন্যদের ক্ষেত্রে ঘটে না। ১০০ জন ডায়াবেটিস রোগীর মধ্যে ১০ জন টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন। এটি বেশি দেখা যায় চল্লিশের কম বয়সীদের মাঝে এবং এখন পর্যন্ত শিশুদের মধ্যে এই প্রকার ডায়াবেটিসই বেশি দেখা যায়।
শর্করা জাতীয় খাবার পাকস্থলীতে হজম হয়ে গ্লুকোজে পরিণত হয়। তারপর সেই গ্লুকোজ রক্তস্রোতে মিশে যায়। স্বাভাবিক অবস্থায় গ্লুকোজকে দেহকোষের মধ্যে প্রবেশ করানোর জন্য এ সময় শরীর ইনসুলিন উৎপন্ন করে। কিন্তু টাইপ-১ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে কোনো ইনসুলিন তৈরি হয় না বলে গ্লুকোজ কোষে প্রবেশ করতে পারে না আর তার ফলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ক্রমাগত বাড়তেই থাকে।
টাইপ-১ ডায়াবেটিসের লক্ষণ
শরীর এই গøুকোজের মাত্রা কমাতে চায়, কারণ নির্দিষ্ট মাত্রা অপেক্ষা কম বা বেশিতে শরীর ঠিকমতো কাজ করতে পারে না তা আমরা আগেই জেনেছি।
১. শরীর গøুকোজের অতিরিক্ত বোঝা কমাতে কিডনি দিয়ে একে বের করে দিতে চায়। ফলে যাদের টাইপ-১ ডায়াবেটিস আছে কিন্তু কোনো চিকিৎসা নেননি, তারা ঘন ঘন বাথরুমে যান।
২. কিডনি গøুকোজকে রক্ত থেকে বের করে আনার সময় এর সাথে কিছু পানিও বের হয়ে যায় প্রস্রাব হিসেবে। ফলে টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তি সহজেই তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েন।
৩. প্রস্রাবে গøুকোজের মাত্রা বেশি থাকে বলে এটি ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে। ফলে জেনিটাল ইচিং দেখা যায়।
৪. একইভাবে রক্তেও গøুকোজের মাত্রা বেশি থাকে বলে শরীরের ক্ষত শুকাতে সময় লাগে।
৫. এ ছাড়া গøুকোজ চোখের লেন্সে জমা হয়ে লেন্সের মধ্যকার তরলকে ক্লাউডি করে, ফলে উক্ত ব্যক্তি ঝাপসা দেখতে পারেন।
৬. গøুকোজ কোষের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে না এবং এর ফলে শক্তি উৎপাদিত হতে পারে না বলে ব্যক্তি সবসময় ক্লান্ত বোধ করেন।
৭. কিন্তু স্বাভাবিক কাজের জন্য শরীরের শক্তি প্রয়োজন। এ অবস্থায় শরীর চর্বি কোষ ভেঙে শক্তি উৎপাদন করে বলে ব্যক্তি ওজন হারান।
সুতরাং টাইপ-১ ডায়াবেটিসের প্রধান লক্ষণগুলো হলোÑঘন ঘন বাথরুমে যাওয়া, তৃষ্ণার্ত বোধ হওয়া, জেনিটাল ইচিং হওয়া, ক্ষত দেরিতে শুকানো, চোখে ঝাপসা দেখা, ক্লান্তি বোধ হওয়া এবং ওজন হ্রাস পাওয়া। এই লক্ষণগুলো সাধারণত কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই দেখা দেয় এবং ইনসুলিন দিয়ে চিকিৎসা করা হলে লক্ষণগুলো চলে যায়।
টাইপ-২ ডায়াবেটিস
সাধারণত ৯০% ডায়াবেটিসই টাইপ-২ ধরনের। তবে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে এর প্রাদুর্ভাব বেশি। এই টাইপটি অপেক্ষাকৃত জটিল। এ ক্ষেত্রে, হয় শরীর পর্যাপ্ত ইনসুলিন উৎপন্ন করতে পারে না অথবা পর্যাপ্ত উৎপন্ন করলেও সেই ইনসুলিন ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারে না। কারণ, কোষগুলো ইনসুলিনের উপস্থিতিতে নিয়মমাফিক দরজা খোলে না। এই বিষয়টিকে বলে কোষের ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স, যার সঠিক কারণ আজও জানা সম্ভব হয়নি। তবে সম্প্রতি কিছু গবেষণা বলছে শরীরে অধিক ইনসুলিনের উপস্থিতি থেকেই মূলত ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স সৃষ্টি হয়। যে খাবারগুলো রক্তে ইনসুলিনের মাত্রা বাড়ায় সেগুলো বেশি বেশি খাওয়া এবং ঘন ঘন খাবার গ্রহণ রক্তে ইনসুলিনের মাত্রা বৃদ্ধি করে। আবার আর একটি অভিমত থেকে বলা হয়, শরীর মুটিয়ে যাবার কারণে অর্থাৎ শরীরে অতিরিক্ত চর্বি সঞ্চয়ের ফলে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স হতে পারে। কেননা, সঞ্চিত চর্বি ইনসুলিনকে ঠিকভাবে কাজ করতে দেয় না। এ ক্ষেত্রে বিবেচনার বিষয় এই যে, অধিক ইনসুলিন শরীরে চর্বি সঞ্চয়ের মূল হোতা। তবে সঠিক ওজনসম্পন্ন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স ঘটে।
শর্করা জাতীয় খাদ্য ডায়জেসটিভ সিস্টেম দ্বারা স্বাভাবিকভাবে ভেঙে গøুকোজে পরিণত হয়। এই গøুকোজ তখন রক্তস্রোতের মধ্য দিয়ে অগ্ন্যাশয়ে যায়। অগ্ন্যাশয় তখন ইনসুলিন উৎপন্ন করে, যা গøুকোজের সঙ্গে রক্তস্রোতের মধ্য দিয়ে সেই সব কোষে পৌঁছে, যেখানে শক্তি উৎপাদনের জন্য গøুকোজ প্রয়োজন। টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত পরিমাণ গøুকোজ কোষের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে না। কোষের ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সের কারণে ইনসুলিন ঠিকমতো কোষের দরজা খুলতে পারে না। সুতরাং রক্তে গøুকোজের মাত্রা অনবরত বাড়তে থাকে। যেহেতু রক্তে গøুকোজের মাত্রা বেশি, তাই অগ্ন্যাশয়ও বেশি বেশি ইনসুলিন উৎপন্ন করতে থাকে।
এভাবে একদিকে রক্তে গøুকোজ বাড়ে আর তার প্রতিক্রিয়ায় ইনসুলিন বাড়ে এবং এই অবস্থা আরো জটিল হয় যখন যেসব কোষের শক্তি প্রয়োজন তারা যকৃতে এই ইমার্জেন্সি সিগন্যাল পাঠায় যে, “সঞ্চিত গøুকোজ অবমুক্ত করো”। যকৃৎ তখন গøাইকোজেন ভেঙে গøুকোজ অবমুক্ত করে। রক্তে গøুকোজের মাত্রা বেশি থেকে বেশিতর হতে থাকে এবং তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে ইনসুলিন। এভাবে দীর্ঘদিন অতিরিক্ত ইনসুলিন উৎপাদন করতে করতে অগ্ন্যাশয়ের ইনসুলিন উৎপাদনকারী বেটা কোষগুলো একপর্যায়ে অকেজো হয়ে ইনসুলিন উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।
টাইপ-২ ডায়াবেটিসের লক্ষণ
টাইপ-২ ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলো টাইপ-১ ডায়াবেটিসের মতোই; যেমনÑঘন ঘন বাথরুমে যাওয়া, তৃষ্ণা বোধ করা, জেনিটাল ইচিং, ওজন হারানো, ক্লান্তিবোধ এবং চোখে ঝাপসা দেখা। টাইপ-২ ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলো খুব ধীরে ধীরে আসে এবং কিছু মানুষের ক্ষেত্রে মোটেই কোনো লক্ষণ থাকে না। অনেক সময় ১০ বছর ধরে টাইপ-২ ডায়াবেটিস থাকার পরেও অনেকে বুঝতে পারে না যে তার টাইপ-২ ডায়াবেটিস আছে। বিভিন্নভাবে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের চিকিৎসা করা যায়। বেশির ভাগ লোকের ক্ষেত্রেই খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, কায়িক পরিশ্রম বা ওজন কমানোই যথেষ্ট হতে পারে। কারো কারো ক্ষেত্রে মেডিকেশন প্রয়োজন। প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থায় টাইপ-২ ডায়াবেটিসকে একটি প্রোগ্রেসিভ কন্ডিশন বলা হয় এবং দেখা যায় বেশির ভাগ মানুষেরই কোনো-না-কোনো প্রকার মেডিকেশন প্রয়োজন হয়। তবে সুখের বিষয় এই যে, সাম্প্রতিক কিছু মেটা এনালাইসিস বলছে, টাইপ-২ ডায়াবেটিসকে পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব। শুধু রক্তে ইনসুলিনের মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে আমরা এই রোগটিকে প্রতিহত করতে পারি অনায়াসে।
সাধারণত দুই ধরনের বলা হলেও গত বছরের শুরুতে স¦নামধন্য জার্নাল ‘দ্যা লানসিট ডায়াবেটিস অ্যান্ড এন্ডোক্রাইনোলজি’-তে প্রকাশিত একটি গবেষণা পত্র দাবি করছে ডায়াবেটিস আসলে পাঁচ ধরনের। এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার আগে সুইডেনে লুন্ড ইউনিভার্সিটি ডায়াবেটিস সেন্টার ও ফিনল্যান্ডের ইনস্টিটিউট ফর মলিকুলার মেডিসিনের গবেষকগণ ১৪,৭৭৫ জন রোগীর রক্ত ও অন্যান্য মেডিক্যাল রিপোর্ট বিশ্লেষণ করেন, যার মধ্যে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স, গøাইকেটেড হিমোগেøাবিন, জেনেটিক্স ইত্যাদিকে বিবেচনায় নেয়া হয়। তারা ডায়াবেটিস রোগীদের ৫টি ক্লাস্টারে ভাগ করতে সমর্থ হন, যাদের জেনেটিক প্রোফাইল, রোগের জটিলতা এবং রোগ অগ্রগতির ধরন একে অন্যের থেকে ভিন্ন।
ক্লাস্টার-১ মূলত টাইপ-১ ডায়াবেটিসের মতো, যা সাধারণত কম বয়সীদের হয়। দেখা যায় অন্য সবকিছুর বিবেচনায় এরা সুস্থ হলেও অটোইমিউনিটির কারণে ইনসুলিন উৎপাদন করতে পারে না।
ক্লাস্টার-২-এর রোগীরাও ক্লাস্টার-১-এর মতো ইনসুলিন উৎপাদন করতে পারে না, তবে সেটা অটোইমিউনিটির কারণে হয় না। এ ছাড়া এদের রেটিনোপ্যাথি হওয়ার হার বেশি।
ক্লাস্টার-৩-এর রোগীরা তীব্রভাবে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্ট হয় এবং অন্যদের তুলনায় কিডনির সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
ক্লাস্টার-৪-এর রোগীদের ডায়াবেটিস বেশি ওজনের সাথে সম্পর্কিত এবং
ক্লাস্টার-৫-এর রোগীদের ডায়াবেটিস বেশি বয়সের সাথে সম্পর্কিত।
তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এখনো অনেক কিছুই অজানা থেকে গেছে। সারা পৃথিবীর মানুষকে জেনেটিক এবং পরিবেশের তারতম্য বিবেচনায় ৫০০টি উপগোষ্ঠীতে ভাগ করা যায়। এই বিপুল পরিমাণ পার্থক্য বিবেচনায় নিলে হয়তো ভবিষ্যতে আরো অনেক ধরনের ডায়াবেটিস শনাক্ত করা সম্ভব হবে। যত ত্রæটিহীনভাবে একে শনাক্ত করা যাবে তত নির্ভুলভাবে এর চিকিৎসা করা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়।
টাইপ-১ ডায়াবেটিসের রিস্ক ফ্যাক্টর
ডায়াবেটিসের প্রকৃত কারণ তর্কসাপেক্ষ হলেও উভয় প্রকার ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রেই কিছু রিস্ক ফ্যাক্টরকে নিরূপণ করা গিয়েছে।
১. পরিবারে কারো টাইপ-১ ডায়াবেটিসের ইতিহাস থাকলে বা কারো দেহে টাইপ-১ ডায়াবেটিসের সাথে সম্পর্কিত জিনের উপস্থিতির কারণে এই ডায়াবেটিস হতে পারে।
২. বয়সও একটি ফ্যাক্টর। টাইপ-১ ডায়াবেটিস সাধারণত ৪০ বছর অপেক্ষা কম বয়সে হয়ে থাকে, বিশেষ করে ৪-৭ এবং ১০-১৪ বছর বয়সী বাচ্চাদের সবচেয়ে বেশি হতে দেখা যায়। যদিও যেকোনো বয়সেই এটি হতে পারে।
৩. ব্যক্তির ভৌগোলিক অবস্থানের প্রেক্ষিতেও এ রোগের তারতম্য দেখা যায়। নিরক্ষীয় রেখা থেকে যত দূরে সরে যাওয়া যায়, এ রোগের প্রাদুর্ভাব তত বাড়তে দেখা যায়। তাই ধারণা করা হয় যে ঠান্ডা আবহাওয়ার সাথে টাইপ-১ ডায়াবেটিসের একটা সম্পর্ক থাকতে পারে। আবার, গ্রীষ্মকাল অপেক্ষা শীতকালে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বেশি, এই বিষয়টিও ঠান্ডা আবহাওয়ার সাথে টাইপ-১ ডায়াবেটিসের সম্পর্ককে সমর্থন করে।
টাইপ-২ ডায়াবেটিসের রিস্ক ফ্যাক্টর
টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে যে রিস্ক-ফ্যাক্টরগুলো নিরূপণ করা সম্ভব হয়েছে তাদের মধ্যেÑ
১. ওজন একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। দেখা যায় শরীরে ইনসুলিনের আধিক্য মানুষের ওজন বৃদ্ধি করে। অধিক ইনসুলিন নিঃসৃত হয় এরূপ খাবার গ্রহণ থেকে দেহকোষগুলো ইনসুলিনের প্রতি রেজিস্ট্যান্ট হতে থাকে আর আমরা ইতিমধ্যেই জানি যে, ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সই টাইপ-২ ডায়াবেটিসের প্রধান কারণ।
২. শরীরে চর্বি সঞ্চারের ধরনও টাইপ-২ ডায়াবেটিসের একটি রিস্ক ফ্যাক্টর। যাদের ক্ষেত্রে চর্বি উরু বা নিতম্বে জমা না হয়ে বরং কোমরের চারপাশে জমা হতে থাকে তাদের এই ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
৩. যে যত বেশি অলস জীবনযাপন করে তার ক্ষেত্রে এই ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা তত বাড়ে। শারীরিক কসরত ওজনকে নিয়ন্ত্রণ করে, শরীরে বর্তমান গøুকোজের সঠিক ব্যবহারে সাহায্য করে এবং কোষগুলোকে ইনসুলিনের প্রতি সংবেদনশীল করে তোলে।
৪. পরিবারও একটি বড় রিস্ক ফ্যাক্টর। পরিবারে কারো এই রোগ থাকলে অন্যদের সম্ভাবনাও বাড়ে।
৫. সকল জাতিগত গোষ্ঠীতে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের উপস্থিতি থাকলেও কিছু কিছু গোষ্ঠীতে এর হার বেশি যেমনÑসাউথ এশিয়ান, মেক্সিকান, চায়নিজ। তবে এ ক্ষেত্রে মজার বিষয় হচ্ছে, একটি বিশেষ জাতিগত গোষ্ঠীর, যারা নিজেদের ঐতিহ্যগত খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপন থেকে দূরে সরে গিয়ে ওয়েস্টার্ন খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়েছে, তারা এই ডায়াবেটিসে বেশি আক্রান্ত হয়েছে।
৬. বয়স বাড়ার সাথে সাথেও এই ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। কেননা, বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের পরিশ্রম করার প্রবণতা কমতে থাকে, এতে শরীরে মাংসপেশির পরিমাণ কমে, চর্বির পরিমাণ বাড়ে। তবে গত এক দশকে অপ্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যেও এ রোগের প্রাদুর্ভাব বহুগুণে বেড়ে গেছে।
৭. এ ছাড়া যাদের প্রি-ডায়াবেটিস রয়েছে, অর্থাৎ যাদের রক্তে গøুকোজের মাত্রা কিছুটা বেশি তবে তা ডায়াবেটিস বলে গণ্য হওয়ার জন্য যথেষ্ট না, তাদের পরবর্তীতে এই ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
৮. পলিসিসটিক ওভারিয়ান সিনড্রোম ও জেসটেশনাল ডায়াবেটিসের ইতিহাস আছে এমন মহিলারাও পরবর্তীতে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারেন।
৯. এ ছাড়া উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কলেস্টেরল ও উচ্চ ট্রাইগিøসাইড মাত্রাকেও টাইপ-২ ডায়াবেটিসের জন্য রিস্ক ফ্যাক্টর মনে করা হয়।
জেসটেশনাল ডায়াবেটিস
গর্ভধারণকালীন রক্ত-গøুকোজের মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি থাকলে তাকে জেসটেশনাল ডায়াবেটিস বলে। এ সময় প্লাসেন্টা বিভিন্ন ধরনের হরমোন নিঃসরণ করে, যাদের প্রভাবে রক্তে গøুকোজের মাত্রা বেশি থাকে। সাধারণত এর প্রতিক্রিয়ায় প্যানক্রিয়াসের বেটা সেল প্রয়োজনীয় পরিমাণ ইনসুলিন নিঃসরণ করে রক্তে গøুকোজের মাত্রা স্বাভাবিক রাখে। এর ব্যত্যয় ঘটলে জেসটেশনাল ডায়াবেটিস দেখা দেয়।
সাধারণত শিশু ভ‚মিষ্ঠের পর এটি আপনা-আপনি চলে যায়। তবে যাদের জেসটেশনাল ডায়াবেটিস হয় তাদের পরবর্তীতে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
ডায়াবেটিসে সৃষ্ট জটিলতা
দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত থাকলে রক্তে অতিমাত্রায় গøুকোজের উপস্থিতি বা হাইপারগøাইসেমিয়া থেকে বিভিন্ন ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হয়। হাইপারগøাইসেমিয়া প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে রক্তনালিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং ক্ষতিগ্রস্ত রক্তনালির কারণেই সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ডায়াবেটিস রোগী বিভিন্ন রোগে ভোগে এবং মারা যায়।
হাইপারগøাইসেমিয়ার কারণে যখন বড় রক্তনালিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় তখন তাকে ম্যাক্রোভাসকুলার জটিলতা বলে। অতিরিক্ত গøুকোজ রক্ত ও রক্তনালির দেয়ালে বিদ্যমান বিভিন্ন প্রোটিনের সাথে বিক্রিয়া করে যে এন্ড প্রোডাক্ট তৈরি করে তা রক্তনালির দেয়ালের সর্ববাইরের টিস্যুতে বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটায়, যার প্রেক্ষিতে অ্যাথারোসক্লেরোসিস প্রক্রিয়াটি দ্রæত ঘটতে থাকে। ডায়াবেটিস কীভাবে অ্যাথারোসক্লেরোসিস ঘটায় তা পুঙ্খানুপুঙ্খ নিরূপণ সম্ভব না হলেও ডায়াবেটিস যে অ্যাথারোসক্লেরোসিস ঘটায়, তা প্রতিষ্ঠিত সত্য। অ্যাথারোসক্লেরোসিস থেকে রক্তনালিতে প্ল্যাক সৃষ্টি হয়। এই প্ল্যাককে আমাদের শরীরের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা বহিরাগত ব্যাকটেরিয়া মনে করে আক্রমণ করে। এর ফলে প্ল্যাকের জায়গায় রক্তনালি ফুলে যায় এবং একসময় ফেটে গিয়ে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। হার্টের মাংসপেশিতে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হলে রোগীর বুকে ব্যথা, হার্ট অ্যাটাক এবং মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হলে স্ট্রোক ঘটে।
অন্যদিকে হাইপারগøাইসেমিয়ার কারণে যখন অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র রক্তনালিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় তখন তাকে মাইক্রোভাসকুলার জটিলতা বলে। চোখের রেটিনার ক্ষুদ্র রক্তনালিগুলো নষ্ট হয়ে গেলে অক্সিজেন ও পুষ্টি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে কোষগুলো মারা যায়। এতে রোগীর দৃষ্টিশক্তি কমে যায় এবং একসময় অন্ধ হয়ে যায়। কিডনির ক্ষুদ্র রক্তনালিগুলো নষ্ট হয়ে গেলে কিডনি অকেজো হয়ে যায়। হাইপারগøাইসেমিয়ার কারণে শরীরের পরিধির দিকে ক্ষুদ্র স্নায়ুকলা অকেজো হয়ে পড়ে বলে ডায়াবেটিসে পুরুষের পুরুষত্ব নষ্ট হয়। একই কারণে পায়ের অনুভ‚তি কমে যায়। এর ফলে পায়ে কোনো আঘাত পেলে বা কেটে গেলে রোগী খেয়াল করে না। একসময় সেখানে ক্ষত সৃষ্টি হয় এবং গ্যাংলিয়ন হয়ে পা কেটে ফেলতে হয়।