পানিকে আমরা জীবন বলি আর তা বলি খুবই সঙ্গত কারণে। অন্যান্য খাবার ছাড়া মানুষ ২১ দিন পর্যন্ত অনায়াসেই বাঁচতে পারে আর তার উদাহরণও আছে আমাদের কাছে। অহিংস এবং অবিসংবাদিত নেতা মহাত্মা গান্ধী হিন্দু-মুসলিমের ঐক্য নিয়ে একটি অনশন ধর্মঘট করতে গিয়ে ৭৪ বছর বয়সে ২১ দিন পানি ব্যতীত অন্য কোনো খাবার না খেয়ে বেঁচে ছিলেন।
১৯৬৫ সালে স্কটল্যান্ডের অধিবাসী ২৭ বছর বয়স্ক অ্যাঙ্গুস বারবিয়েরি তার নানা প্রকার ওজনজনিত অসুস্থতা থেকে মুক্তি পেতে ফাস্টিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি একটানা ৩৮২ দিন না খেয়ে ছিলেন এবং এতে করে তার ওজন ২০৭ কেজি থেকে নেমে হয়েছিল ৮১ কেজি, ঠিক যেমনটা তিনি চেয়েছিলেন।
তবে তিনি পুরোটা সময় ডানডি রয়েল ইনফার্মারি হাসপাতালের ডাক্তারের তত্তাবধানে ছিলেন। ডাক্তার তার শরীরের গতিবিধিগুলো যাচাই করে দেখতেন এবং মাঝে মাঝে কিছু সোডিয়াম, পটাশিয়ামসহ মাল্টিভিটামিন ও ইস্ট খেতে দিতেন। এক মাস পর থেকে তিনি অবশ্য র চা, ব্লাক কফি এবং সোডা পানি খেতেন। এই এক বছর ১৭ দিন তিনি কোনো খাবার খাননি আর তার ডাক্তারদের অবাক করে দিয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত সুস্থ ছিলেন।
কিন্তু ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া এমন কাজ করা কারো ঠিক হবে না। খাবার ছাড়াও যে মানুষ দীর্ঘ সময় চলতে পারে এটি তার একটি উদাহরণ মাত্র।তবে অধিকাংশ চিকিৎসা বিজ্ঞানী মনে করেন, একজন সুস্থ মানুষ শক্ত খাবার ব্যতীত শুধু পানি পান করে সর্বোচ্চ ৮ সপ্তাহ বাঁচতে পারে। অন্যদিকে পানি ছাড়া মানুষ শুধু ৭ দিন বাঁচতে পারে।
একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের শরীরের ৬০ ভাগই পানি আর শিশুদের ক্ষেত্রে তা ৭৪ ভাগ। পানি শরীর থেকে অপ্রয়োজনীয় ও দূষিত উপাদানগুলোকে কোষের বাইরে নিয়ে আসে, কোষে কোষে পুষ্টি উপাদান পৌঁছে দেয়, শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে এবং খাবার হজমে সাহায্য করে।
যথেষ্ট পরিমাণ পানি পান না করলে ভীষণ জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। অন্যান্য উপাদানের মতো পানি এবং তাতে দ্রবীভ‚ত লবণেরও একটি সুসম অবস্থা বিরাজ করা সুস্থ জীবনযাপনের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। মাথায় রাখা জরুরী যে সুসম অবস্থা, কম বা বেশি নয়। কারণ, পানিস্বল্পতার মতো পানির আধিক্যও বিপদ ডেকে আনতে পারে। সাম্প্রতিক কয়েকটি খবর এই বিষয়টি নিয়ে ভাবার অবকাশ তৈরি করেছে।
যারা শারীরিক কসরত করেন, বিশেষ করে ম্যারাথন দৌড়বিদগণ অনেক সময় পানিস্বল্পতা রোধ করতে এবং কিছু খেয়ালি মানুষ বাজি ধরে একসাথে অনেক পানি খেয়ে ফেলেন। এই পানি কিডনিকে ভারাক্রান্ত করে। একবারে যতটুকু পানি কিডনি ছাঁকতে পারে তার থেকে বেশি পানি এখানে জমা হয়ে যায়, যা সে বের করতে পারে না।
এই পানি তখন শরীরের অন্যান্য কোষকলায় জমা হতে থাকে। আর যখন পানি ব্রেইন সেলে জমে তখন-ই ঘটে বিপত্তি। সংজ্ঞা হারানো থেকে শুরু করে কমা, শ্বাসক্রিয়া বন্ধ এমনকি মৃত্যুও ঘটতে পারে। তাই প্রয়োজনের বেশি পানি শরীরের দরকার নেই।
শরীরে কী পরিমাণ পানি প্রয়োজন তা বেশ কতগুলো বিষয়ের ওপর নির্ভর করে, যেমন, আপনার কাজের ধরন, ওজন, খাবারের ধরন, সঞ্চিত চর্বির পরিমাণ, আপনার চারপাশের পরিবেশ বিশেষ করে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ ও তাপমাত্রা ইত্যাদি। যিনি খোলা মাঠে কাজ করেন আর যিনি অফিস কক্ষে বসে কাজ করেন তাদের পানির প্রয়োজনীয়তা এক সমান নয়।
আবার আপনি যদি লবণ জাতীয় খাবার বেশি খান তবে অতিরিক্ত লবণ শরীর থেকে বের করতে অপেক্ষাকৃত বেশি পরিমাণ পানি পানের প্রয়োজন হবে। অন্যদিকে যেই লোকটি কম লবণ খান তার আপনার থেকে কম পানি খেলেই চলবে। শুকনো খাবার বেশি খেলেও শরীরকে হাইড্রেটেড রাখতে অপেক্ষাকৃত বেশি পরিমাণ পানি প্রয়োজন হবে।
তথাপি, দিনে একজন মানুষ কী পরিমাণ পানি পান করবেন এ বিষয়ে একটি ধারণা প্রচলিত রয়েছে।এটি হলো ৬৪ আউন্স পানি বা ৮ আউন্সের গ্লাসে ৮ গ্লাস পানি যাকে অনেক সময় সহজ করে ‘৮ ৮’ নিয়ম বলা হয়।
সমস্যা হচ্ছে, ব্যস্ত নাগরিক জীবনে অনেকেই এই ‘৮ ৮’ নিয়মটি মেনে চলতে পারেন না বলে দুশ্চিন্তায় থাকেন। ভাবেন, তারা হয়তো সঠিক পরিমাণ পানি পান করছেন না এবং হয়তো পানিস্বল্পতায় ভুগছেন।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বেশির ভাগ মানুষই তার শরীরের প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানি পান করে থাকেন, হয়তো সেটা শুধু পানি হিসেবে পান করেননি, বরং অন্য কোনো পানীয় (চা, কফি, স্যুপ, ফলের জুস) বা খাবারের জলীয় অংশ (ফুলকপি, বাঁধাকপি, বেগুন, পটল, লাউসহ বেশির ভাগ সবজি ও ফলের ৮০ থেকে ৯০ ভাগই পানি) হিসেবে খেয়েছেন।
আমরা আসলে আমাদের প্রয়োজনীয় পানির ৬০ ভাগ গ্রহণ করি বিশুদ্ধ পানি থেকে, ৩০ ভাগ পাই আর্দ্র খাবার থেকে এবং ১০ ভাগ পানি শরীরের ভিতরে বিভিন্ন প্রাণ-রাসায়নিক বিক্রিয়া থেকে উৎপন্ন হয়। আর এই যে দিনে ‘৮ ৮’ বা ৬৪ আউন্স পানি পানের বিষয়টি, এটি আসলে একটি ভ্রান্ত ধারণা।
এই ধারণাটি সম্ভবত ১৯৪৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন বোর্ডের একটি রেকমেন্ডেশনের ভুল ব্যাখ্যা থেকে এসেছিল। এখানে বলা হয়েছিল যে, প্রতি ক্যালরি খাবার (যে পরিমাণ খাবার থেকে ১ ক্যালরি শক্তি উৎপন্ন হয়)-এর জন্য একজন ব্যক্তির এক মিলি. পানির প্রয়োজন হয়। তাহলে ২০০০ ক্যালরির একটি গড় খাবারের জন্য প্রয়োজন ২০০০ মিলি. বা ৬৪ আউন্স পানি।
অর্থাৎ যেকোনোভাবে তার শরীরে ৬৪ আউন্স পানি থাকলেই হলো, যদি তিনি ২০০০ ক্যালরির খাবার গ্রহণ করে থাকেন। সে সময় মানুষ ধরে নিল যে দিনে একজন মানুষকে ৬৪ আউন্স বা প্রায় ২ লিটার পানি পান করতে হবে। কিন্তু প্রায় সব খাবারের মধ্যেই যে কিছু অংশ পানি আছে এবং আছে অন্যান্য পানীয়, তা মানুষ হিসেবের মধ্যে নেয়নি।
এই দৈনিক ২ লিটার পানি পানের ওপর হয়েছে বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা। ২০০২-এ আমেরিকান জার্নাল অব ফিজিওলজি এবং ২০০৮-এ আমেরিকান সোসাইটি অব নেফ্রোলজি’র জার্নাল-এ প্রকাশিত পৃথক দুটি পেপারে দেখা যায় যে ‘৮ ৮’ নিয়মটির স্বাস্থ্য সুরক্ষায় তাৎপর্যপূর্ণ কোনো ভ‚মিকা নেই।
এখন মজার বিষয় হচ্ছে, সেই ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন বোর্ড, যেটি এখন ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব মেডিসিন-এর একটি অংশ, বলছে ২ লিটার নয়, বরং দিনে একজন গড় পুরুষের ৩.৭ লি. এবং একজন গড় মহিলার ২.৭ লি. পানি প্রয়োজন। তবে হ্যাঁ, এ পানি মানে শুধু পানি নয়, বরং খাবারের অংশ হয়ে থাকা পানি এবং অন্যান্য পানীয় এর আওতায় পড়বে।
তাছাড়া, ব্যক্তিভেদে পানির প্রয়োজনীয়তাটা অনেক কম-বেশি হয় বলে দেখা যায় বেশির ভাগ মানুষেরই এর (৩.৭ লি. এবং ২.৭ লি.) থেকে অনেক কম পানি পান করলেই চলে। যাই হোক না কেন, আবার তো সেই হিসাবের মধ্যেই পড়ে গেলাম। যে হিসাব করে কু্ল পাওয়া যাবে না সে হিসাব বাদ দিয়ে বরং শরীরের তৃষ্ণা কেন্দ্রের শরণাপন্ন হওয়া বেশি সুবিধাজনক।
শারীরবৃত্তীয় বহু কাজের কাজী হাইপোথ্যালামাসে আছে ‘তৃষ্ণা কেন্দ্র’ নামে একটি অংশ, যেটা দেহে পানির সুসম অবস্থা নিশ্চিত করার পাশাপাশি শরীরের তাপমাত্রা, ঘুম এবং ক্ষুধারও সুসম অবস্থা নিশ্চিত করে। এই তৃষ্ণা কেন্দ্রটি সবসময় রক্তে লবণ ও অন্যান্য উপাদানের ঘনত্ব এবং সেই সাথে রক্তের মোট পরিমাণ ও চাপ মনিটরিং করে।
যখন রক্তপাত, ঘাম বা ডায়রিয়ায় পানিস্বল্পতার কারণে রক্তচাপ কমে যায় এবং যখন অতিরিক্ত লবণ খাবার কারণে বা বিশেষ কোনো রোগের কারণে রক্তে সোডিয়ামের ঘনত্ব বেড়ে যায় তখন এই তৃষ্ণা কেন্দ্র স্নায়ুপথে পানি পানের জোরালো বার্তা পাঠায় শরীরের অন্যান্য অংশে।
তাদের সামগ্রিক কাজে আমরা তৃষ্ণা বোধ করি ও পানি পানে উদ্যোগী হই এবং সেই সাথে এটি পিটুইটারি গ্লান্ডকে কিছু হরমোন নিঃসরণ করতে বলে। এই হরমোনগুলো কিডনিতে পৌঁছে সেখানে ইউরিন থেকে পুনরায় পানি শোষণ করে রক্তস্রোতে নিয়ে আসে।
এভাবে শরীর তার নিজস্ব মেকানিজম ব্যবহার করে প্রাকৃতিক ডাক (তৃষ্ণাবোধ) দেয়। আমরা যদি সে ডাকে সাড়া দিতে পারি তাহলে আর বাড়তি টেনশনের কারণ নেই। যদিও অনেক সময় কিছু মানুষ এই তৃষ্ণার বোধটি হারিয়ে ফেলেন। বিশেষ করে বৃদ্ধরা এই সমস্যায় পড়েন।
এ ছাড়া কিছু ব্রেইন ইনজুরিও তৃষ্ণার সহজাত বোধটিকে নষ্ট করে ফেলে। তবে সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের এত চিন্তা করে শরীরে স্ট্রেস হরমোন না বাড়ানোই ভালো। বরং কতটুকু পানি পান করবেন তা আপনার তৃষ্ণাবোধ ও প্রস্রাবের রং এবং গন্ধের ওপর ছেড়ে দিতে পারেন।
সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে একজন সুস্থ মানুষের প্রস্রাবের রং হালকা হলুদাভ থেকে সোনালি বর্ণের হয়। যকৃতের তৈরিকৃত পানিতে দ্রবণীয় ইউরোক্রোমের উপস্থিতির কারণে এরূপ রং হয়। অনেক সময় প্রস্রাবের কোনো রং-ই থাকে না। এমন হলে বুঝতে হবে যে শরীরের প্রয়োজনের তুলনায় বেশি পানি পান করা হয়েছে।
এছাড়া শরীর থেকে অতিরিক্ত পানি বের করে দেয়ার নিমিত্তে সেবন করা ডাইইউরেটিক ড্রাগ থেকেও এমন রং হতে পারে। প্রস্রাবের রং গাঢ় বা অনেকটা মধুর মতো হলে বুঝতে হবে শরীর পানিস্বল্পতায় ভুগছে।
তবে দু-এক দিনের বেশি এমন রং বজায় থাকলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। কেননা, যকৃতের সমস্যা থেকেও এমনটা হতে পারে। বিশেষ প্রকার খাবার ও ওষুধ অনেক সময় প্রস্রাবের রং সাময়িকভাবে পরিবর্তন করে।
প্রস্রাবের গন্ধ সাধারণত খুব হালকা হয়। সালফার-সমৃদ্ধ খাবার ও ভিটামিন বি-৬ খেলে প্রস্রাবের গন্ধে লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখা যায়। তবে পানিস্বল্পতায় ভুগলে প্রস্রাবে প্রকট অ্যামোনিয়ার গন্ধ পাওয়া যায়। এমন হলে পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে।
আর যদি একটু অন্য রকম তীব্র গন্ধ হঠাৎ নাকে লাগে তবে এটি ইউরিনারি ট্রাক ইনফেকশন, ব্লাডার ইনফেকশন, ডায়াবেটিস বা মেটাবলিক ডিজিজ থেকে হতে পারে। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকের দ্বারস্থ হতে হবে।