মাইক্রোসাইটিক, হাইপোক্রোমিক অ্যানিমিয়া রক্তাল্পতার এমন একটি ধরন যেখানে লোহিত রক্তকনিকাগুলি স্বাভাবিক আকারের লোহিত রক্তকনিকা থেকে ছোট (মাইক্রোসাইটিক) এবং অপেক্ষাকৃত কম লাল(হাইপোক্রোমিক) হয়। লোহিত রক্তকণিকাতে হিমোগ্লোবিন নামে একটি গ্লোবিউলার প্রোটিন বিদ্যমান যা অস্থি মজ্জার এরিথ্রয়েড প্রোজেনিটার কোষ হতে তৈরি হয়। এই হিমোগ্লোবিন এর চারটি গ্লোবিন চেইন রয়েছে যার মধ্যে দুটি আলফা-গ্লোবিন চেইন এবং বাকি দুটি বিটা-গ্লোবিন চেইন, এই চারটি চেইন একটি পোরফাইরিন রিং (হিম) এর সাথে সংযুক্ত যার কেন্দ্রে আয়রন (ফেরাস আকারে) থাকে। এই আয়রন অক্সিজেনের চারটি অণুকে আবদ্ধ করতে সক্ষম। আয়রন-ই হিমোগ্লোবিনের প্রধান উপাদান এবং অক্সিজেনের প্রধান বাহক। দেহে আয়রনের মজুদ কমে গেলে হিমোগ্লোবিনের উৎপাদন ব্যহত হয় এবং নবগঠিত লোহিত কনিকাতে হিমোগ্লোবিন এর ঘনত্ব কমতে শুরু করে। যেহেতু হিমোগ্লোবিনের কারণে লোহিত কণিকাকে লাল দেখায় সেহেতু এর ঘনত্ব কমে যাওয়ার ফলে নবগঠিত লোহিত কণিকার রঙ ফিকে দেখায়। এইভাবেই এর নাম হয়েছে হাইপোক্রোমিক। আবার, যেহেতু সদ্য উৎপাদিত লোহিত কণিকায় হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কম থাকে সেহেতু স্বাভাবিক লোহিত কণিকার তুলনায় এগুলি অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের হয়। এইভাবে এর নাম হয়েছে মাইক্রোসাইটিক। লোহিত কণিকাতে হিমোগ্লোবিন হ্রাস পেলে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গে অক্সিজেন এর অভাব সৃষ্টি করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এর রোগবিস্তার-সংক্রান্ত তথ্য অনুসারে, বর্তমানে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ২৪.৮% রক্তস্বল্পতায় ভুগছে যার মধ্যে একটি বড় অংশ আয়রনের ঘাটতিজনিত কারণে। হাইপোক্রোমিক মাইক্রোসাইটিক অ্যানিমিয়া প্রিমেনোপজাল মহিলাদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে তারা মাসিক চক্রের কারণে অনিয়মিত, দীর্ঘস্থায়ী ও ভারী রক্ত ক্ষরণে ভোগে। গর্ভবতী মহিলাদের মধ্যে প্রায় ৪১% রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন এবং অগর্ভবতী প্রাক-মেনোপজাল মহিলাদের মধ্যে ৩০% মহিলার রক্তাল্পতা রয়েছে। রক্তে টেসটোসটেরনের তুলনামূলক বেশি উপস্তিতির কারণে পুরুষদের ক্ষেত্রে রক্তাল্পতা কম দেখা যায়। তারপরও, ১২.৭% প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ বিশ্বব্যাপী রক্তাল্পতায় আক্রান্ত। মহিলা জনসংখ্যার পরে, প্রাক-স্কুল-বয়সী শিশুরা তাদের প্রধান খাদ্যে আয়রনের অভাবে রক্তশূন্যতায় সবচেয়ে বেশি ভোগে। ২০১১ সালে, বাংলাদেশে রক্তাল্পতার প্রকোপ ছিল ৬-৫৯ মাস বয়সী শিশুদের মধ্যে ৫১% এবং অ-গর্ভবতী মহিলাদের মধ্যে ৪২%।
লক্ষণ:
মাইক্রোসাইটিক হাইপোক্রোমিক অ্যানিমিয়ার ক্ষেত্রে, লোহিত রক্তকণিকার কোষের গড় আয়তন বা MCV ৮০-এর নিচে। এই ধরনের অ্যানিমিয়ার সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ হল মাথা ঘোরা, ক্লান্তি বোধ, দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট, মাথাব্যথা, অবসাদ, কাজে উদ্যোম হারিয়ে ফেলা, শক্তি কমে যাওয়া, ত্বক ফ্যাকাশে হওয়া।
মাইক্রোসাইটিক হাইপোক্রোমিক অ্যানিমিয়ার কারণ:
শরীরে আয়রনের ঘাটতি মাইক্রোসাইটিক হাইপোক্রোমিক অ্যানিমিয়ার মূল কারণ । আয়রন হিমোগ্লোবিন তৈরির জন্য শরীরের প্রয়োজনীয় একটি অপরিহার্য উপাদান। শরীরে আয়রনের মাত্রা কম হলে শরীরে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যায়, ফলে শরীরে রক্তের অক্সিজেন বহন ক্ষমতা কমে যায়। শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে আয়রনের অভাবে উৎপন্ন লোহিত রক্তকণিকা স্বাভাবিক লোহিত কণিকার তুলনায় ছোট এবং ফ্যাকাশে দেখায়। মাইক্রোসাইটিক হাইপোক্রোমিক অ্যানিমিয়ার সবচেয়ে সাধারণ কারণগুলি নীচে বলা হল:
অত্যধিক রক্তক্ষরণ:
বিভিন্ন কারণে শরীরের অভ্যন্তরে রক্তক্ষরণ হতে পারে। এটি একবারে বেশি পরিমানে অথবা দীর্ঘদিন ধরে একটু একটু করে হতে পারে। অভ্যন্তরীণ রক্তপাতের সবচেয়ে সাধারণ কারণ হল আলসার, অন্ত্রের প্রদাহজনক অবস্থা, হেমোরয়েডস (অর্শরোগ) এবং গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ট্র্যাক্ট বা পরিপাক নালির অন্যান্য ব্যাধি। অ্যাসপিরিন এবং অন্যান্য প্রদাহরোধী ওষুধের দীর্ঘায়িত ব্যবহার থেকেও পরিপাক নালিতে রক্তপাত হতে পারে। ঋতুস্রাবের সময় প্রচুর রক্তপাত মহিলাদের মধ্যে রক্তস্বল্পতা ঘটায়। কিছু মহিলার ক্ষেত্রে, জরায়ুর ফাইব্রয়েডের কারণে অত্যধিক রক্তক্ষরণ হতে পারে। অন্যান্য কারণগুলির মধ্যে রয়েছে আঘাত, দুর্ঘটনা বা কোন ব্যাধি থেকে রক্তপাত। অত্যধিক রক্তক্ষরণের সাথে, শরীর থেকে আয়রন চলে যায় যা রক্তাল্পতা সৃষ্টি করে।
খারাপ ডায়েট:
মানুষের শরীর আয়রন উৎপাদন করতে পারে না । তাই, অক্সিজেন পরিবহন এবং শক্তি উৎপাদনের মতো গুরুত্বপূর্ণ শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত এই খনিজটির বাহির থেকে সরবরাহ জরুরী। খাদ্য হল আয়রনের একমাত্র প্রাকৃতিক উৎস। আমাদের শরীর প্রতিদিন কিছু আয়রন হারায় যার প্রতিস্থাপন প্রয়োজন। শরীর এই খনিজটিকে পুনর্ব্যবহার করতে পারে বলে দৈনিক চাহিদার মাত্র ৫ থেকে ১০% আয়রন খাদ্য থেকে গ্রহণ করতে হয়। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের প্রতিদিন ১ মিলিগ্রাম থেকে ২ মিলিগ্রাম আয়রন প্রয়োজন। খাদ্য থেকে আয়রন দুইভাবে আসে: হিম আয়রন এবং অ-হিম আয়রন। সমস্ত উদ্ভিদ থেকে প্রাপ্ত এবং প্রাণী থেকে প্রাপ্ত খাবারে অ-হিম আয়রন থাকে, যখন হিম আয়রন শুধুমাত্র প্রাণী থেকে প্রাপ্ত খাবারে পাওয়া যায়, বিশেষ করে মাংস, মাছ, মুরগি এবং ডিম থেকে। হিম আয়রনের জৈব উপলভ্যতা অপেক্ষাকৃত বেশি এবং শোষণ-বর্ধক কোফ্যাক্টরের প্রয়োজন ছাড়াই সহজে অন্ত্র হতে দেহাভ্যন্তরে শোষিত হয়। অ-হিম আয়রন, যা নিরামিষাশীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যের উৎস, কম জৈব উপলভ্যতা দেখায়; এর শোষণ নির্ভর করে খাদ্যে বিদ্যমান শোষণে সহায়ক ও বাধাপ্রদানকারী উপাদানের পরিমান এবং শরীরের আয়রন মজুদের মধ্যে ভারসাম্যের উপর। খাদ্যে বিদ্যমান হিম আয়রনের প্রায় ২৫% শোষিত হয়, যখন অ-হিম আয়রনের শোষিত হয় ১৭% । সুতরাং উপরোক্ত আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খাদ্য তালিকায় না থাকলে রক্তাল্পতার ঝুঁকি বাড়ে।
অন্যান্য রোগের কারনে:
এমন কিছু অসুখ আছে যার উপস্থিতিতে শরীরে আয়রনের মাত্রা মারাত্মকভাবে হ্রাস পেতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে সংক্রমণ, প্রদাহ এবং কার্সিনোমা এর উপস্থিতি। এই অবস্থাগুলি দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকলে লোহিত রক্তকণিকার উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে এবং এটি লোহিত রক্তকণিকার জীবনকালও কমিয়ে দিতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে, লোহিত রক্তকণিকার স্বাভাবিক পুনর্ব্যবহারে ব্যাঘাত ঘটে যার ফলে শরীরে আয়রনের মাত্রা অপর্যাপ্ত হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, অবস্থাটি নরমোসাইটিক অ্যানিমিয়া হিসাবে শুরু হয় যা শেষ পর্যন্ত মাইক্রোসাইটিক অ্যানিমিয়ায় পরিণত হয়।
সীসা বিষক্রিয়া:
সীসার বিষক্রিয়ার ফলে শরীরে আয়রনের ঘাটতি সহ মারাত্মক পরিণতি হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে আয়রন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের পরও শরীরের আয়রনের মাত্রার উন্নতি হয় না। এটি একটি অত্যন্ত গুরুতর অবস্থা এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সমাধান করা উচিত।
মাইক্রোসাইটিক হাইপোক্রোমিক অ্যানিমিয়ার চিকিৎসা:
মাইক্রোসাইটিক হাইপোক্রোমিক অ্যানিমিয়ার চিকিৎসা আয়রন স্বল্পতার অন্তর্নিহিত কারণের উপর নির্ভর করে। অবস্থার কারণের উপর ভিত্তি করে, নিম্নলিখিত চিকিৎসা বিবেচনা করা হয়।
রক্তক্ষরণের চিকিৎসা:
যদি রক্তক্ষরণের কারনে হয়ে থাকে তবে রক্তক্ষরণ বন্ধ করার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। পরিপাক নালির রক্তপাতের ক্ষেত্রে, পেটের আল্ট্রাসাউন্ড, উপরের গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল এন্ডোস্কোপি এবং পেটের সিটি স্ক্যানের মতো বিশেষ টেষ্ট গুলো করা প্রয়োজন। আক্রান্ত ব্যক্তিদের আরও ভালো চিকিৎসার জন্য সাধারণত একজন গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্টের কাছে রেফার করা হয়।
ভারী ঋতুস্রাব আছে এমন প্রি-মেনোপজাল মহিলাদের ক্ষেত্রে হরমোনাল থেরাপি (যেমন জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি) বিবেচনা করা হয়। জরায়ু ফাইব্রয়েড এবং অন্যান্য অনুরূপ অবস্থার ক্ষেত্রে, সার্জারি বা রেডিয়েশন থেরাপি বিবেচনা করা যেতে পারে।
দ্রুত আয়রন ঘাটতি পূরণ করার জন্য খাবারের পাশাপাশি চিকিৎসকরা আয়রন এবং ভিটামিন সি সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের পরামর্শ দেন। আয়রন সাপ্লিমেন্ট হারানো আয়রন পূরণে সাহায্য করে; অন্যদিকে, ভিটামিন সি ব্যক্তির আয়রন ভালোভাবে শোষণ করার ক্ষমতা বাড়ায়।
যেসব ক্ষেত্রে পরিস্থিতি এতোটাই খারাপ হয় যে, রোগীর কার্ডিয়াক জটিলতা হওয়ার ঝুঁকি তৈরী হয় সেক্ষেতে চিকিৎসক বাহির থেকে রক্ত প্রদান বিবেচনা করেন।
প্রতিরোধ:
মাইক্রোসাইটিক হাইপোক্রোমিক অ্যানিমিয়া সহ যেকোনো ধরনের অ্যানিমিয়া প্রতিরোধ করার সর্বোত্তম উপায় হল খাদ্যতালিকায় পরিবর্তন। আয়রনের ঘাটতি এড়াতে আয়রন সমৃদ্ধ খাবার অনুসরণ করার পরামর্শ দেওয়া হয়। এর পাশাপাশি ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবারের বর্ধিত পরিমাণও শরীরে আয়রনের শোষণ বাড়াতে সাহায্য করে। যদি খাদ্যের মাধ্যমে পুষ্টির চাহিদা পূরণ না হয় তবে অতিরিক্ত আয়রন এবং ভিটামিন সি সাপ্লিমেন্ট বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েই এগুলো গ্রহণ করা উচিত।
আয়রন সমৃদ্ধ খাবারের মধ্যে রয়েছে লাল মাংস যেমন গরুর মাংস, মাটন, ভেড়ার মাংস, কলিজা ইত্যাদি; মুরগীর মাংস; মাছ; গাঢ় শাক যেমন পুই শাক; এবং ডাল যেমন মটরশুটি, মসুর, ছোলা; কাজু বাদাম, কুমড়ার বীজ ইত্যাদি। তবে, এক্ষেত্রে বিবেচনায় রাখতে হবে যে, প্রাণী থেকে প্রাপ্ত খাবারে হিম আয়রন থাকে যার জৈব-উপলভ্যতা বেশি অর্থাৎ শরীর একে ভালো শোষণ করতে পারে। অন্যদিকে উদ্ভিদ থেকে প্রাপ্ত খাবারে অ-হিম আয়রন বিদ্যমান যা শরীর ভালো শোষণ করতে পারে না।
ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবারের মধ্যে রয়েছে: সাইট্রাস ফল যেমন লেবু, কমলা, জাম্বুরা ইত্যাদি। অন্যান্য ফল যেমন পেঁপে, লিচু, পেয়ারা ইত্যাদি। শাকসবজি যেমন মরিচ, ব্রকলি ইত্যাদি।
উপসংহার:
মাইক্রোসাইটিক হাইপোক্রোমিক অ্যানিমিয়া মূলতঃ আয়রনের অভাবে হয়ে থাকে। এটি অস্বাস্থ্যকর জীবনধারা, খাদ্যের ঘাটতি বা অন্যান্য অন্তর্নিহিত শারীরীক অবস্থার কারণে হতে পারে। এটি একটি গুরুতর স্বাস্থ্যগত অবস্থা । তাই, অবস্থার সঠিক কারণ নির্ধারণের জন্য শীঘ্রই একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ প্রয়োজন। অন্তর্নিহিত কারণের উপর ভিত্তি করে এর চিকিৎসা নির্ধারণ করা হয় যাতে জীবনধারা এবং খাদ্যতালিকাগত পরিবর্তন অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।