হাইপোথাইরয়েডিজম হল সেই অবস্থা যখন থাইরয়েড গ্রন্থি পর্যাপ্ত থাইরয়েড হরমোন উৎপাদন করতে পারে না। এসময় ক্লান্তি, ওজন বৃদ্ধি, কোষ্ঠকাঠিন্য, শুষ্ক ত্বক, শুষ্ক বা পাতলা চুল এর মত উপসর্গগুলো দেখা যায়।
হাইপোথাইরয়েডিজম প্রথমত কম থাইরয়েড হরমোন (T3 এবং T4) নিঃসরনের কারণে হয়। অনেকগুুলো কারণে কম হরমোন তৈরী হতে পারে। সবচেয়ে বেশি দেখা যায় হাশিমোটো’স থাইরয়েডাইটিস। হাশিমোটো মূলতঃ বংশগত। এ রোগে, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা থাইরয়েডকে আক্রমণ করে এবং ক্ষতিগ্রস্থ করে। ফলে, থাইরয়েড পর্যাপ্ত থাইরয়েড হরমোন তৈরি এবং নিঃসরণ করতে পারে না।
অন্যান্য যে কারণে কম হরমোন নিঃসরন হয় তারমধ্যে আছে থাইরয়েডাইটিস (থাইরয়েডের প্রদাহ), আয়োডিনের অভাব (আয়োডিন থাইরয়েড হরমোনের গাঠনিক অংশ), হাইপারথাইরয়েডিজমের চিকিৎসার পার্শ্বপতিক্রিয়ায় যেমন, থাইরয়েডে বিকিরণ দিলে বা থাইরয়েড অপসারণ করলে। কিছু ক্ষেত্রে, গর্ভাবস্থা (প্রসবোত্তর থাইরয়েডাইটিস) বা ভাইরাল অসুস্থতার পরে থাইরয়েডাইটিস ঘটতে পারে।
আরেকটি যে কারণে হাইপোথাইরয়েডিজম হয় তা হল কোন করণে পিটুইটারি গ্রন্থি যদি পর্যাপ্ত থাইরয়েড উদ্দীপক হরমোন (TSH) পাঠাতে না পারে। TSH হরমোনই থাইরয়েড গ্রস্থিকে পর্যাপ্ত থাইরয়েড হরমোন তৈরির বার্তা দেয় । তাই TSH কমে গেলে থাইরয়েড হরমোন কমে যায়।
হাইপোথাইরয়েডিজমের চিকিৎসা মোটামুটি সহজ। এটি মূলত বাহির থেকে কিছু থাইরয়েড হরমোন গ্রহণ করা। তবে, ডোজ ঠিক করতে কিছু ক্ষেত্রে একটু সময় লাগতে পারে। সাধারণত চিকিৎসা নেয়ার পর রোগীরা হাইপোথাইরয়েডিজম এর বিভিন্ন উপসর্গ থেকে মুক্তি পায়।
তারপরও দেখা যায়, অনেক রোগী হাইপোথাইরয়েডিজম থাকা সত্ত্বেও চিকিৎসা গ্রহণ করছেন না। কারণ, হয়তো তারা চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াতে ভালো অনুভব করেন না অথবা অনেকসময় তারা জানেনই না যে তাদের এই রোগটি আছে। এই ক্ষেত্রে, হাইপোথাইরয়েডিজম অবস্থাটি ধীরে ধীরে আরও গুরুতর হয়ে উঠতে পারে।
থাইরয়েড হরমোন বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ শারীরবৃত্তীয় কাজের সাথে জড়িত বলে এর সঠিক চিকিৎসা না হলে হাইপোথাইরয়েডিজম ব্যাপক ক্ষতির কারণ হতে পারে। যেমন নিচের সাতটি জটিলতার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
গলগন্ড
থাইরয়েড গ্রন্থি অঙ্গটি যখন থাইরয়েড হরমোন তৈরির জন্য অতিরিক্ত প্রচেষ্টা করে তখন এর আকার বৃদ্ধি পায় এবং বাহির থেকেও তা বোঝা যায। একেই গলগন্ড বলে।
বিষয়টি এমন যে, যখন রক্তে থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা কম থাকে তখন আমাদের মস্তিষ্ক আমাদের থাইরয়েডকে বলে আরো হরমোন তৈরি করতে হবে। এটা সে কিভাবে বলে? এক্ষেত্রে মধ্য মস্তিষ্কে অবস্থিত হাইপোথ্যালামাস পিটুইটারীকে বলে থাইরয়েড-উত্তেজক হরমোন (TSH) নামে একটি হরমোন তৈরি করতে। এই TSH থাইরয়েড গ্রন্থিকে বার্তা দেয় যে আরো বেশি হরমোন তৈরী কর। থাইরয়েড তখন থাইরয়েড হরমোন এর উৎপাদন বাড়াতে আপ্রান চেষ্টা করতে থাকে এবং এসময় থাইরয়েড গ্রন্থিটি বড় হতে থাকে। কারণ, বেশি উৎপাদনের জন্য তো বেশি বেশি উৎপাদনকারী কোষ প্রয়োজন।
গলগন্ড হাইপোথাইরয়েডিজম এর একটি প্রাথমিক সতর্কতা চিহ্ন। এমনকি রক্তে থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিকের নিচে নেমে যাওয়ার আগেই গলগন্ড দেখা দিতে পারে। তাই, এটি দেখা দেয়া মাত্র রক্তে TSH মাত্রা পরীক্ষা করা উচিত।
গলগন্ড সাধারণত বিপজ্জনক বা অস্বস্তিকর নয়। তবে, অনেক সময় খাবার গিলা বা শ্বস-প্রশ্বাসে অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে।
হৃদরোগ
হাইপোথাইরয়েডিজম এর কারণে শরীরে পানি ধারণের প্রবণতা দেখা যায়। যা একপর্যায়ে উচ্চ রক্তচাপ এবং কনজেস্টিভ হার্ট ফেইলিওর (যখন হার্ট পর্যাপ্ত পরিমাণে রক্ত পাম্প করতে পারে না) সৃষ্টি করতে পারে।
হাইপোথাইরয়েডিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রায়শই যে ওজন বৃদ্ধি পায় তার প্রধান কারণ এই পানি ধারণ। এক্ষেত্রে পায়ের গোড়ালি ফুলে যায় এবং মুখমন্ডল ফোলা দেখায় যা শুধু চর্বি বৃদ্ধির কারণে ওজন বাড়লে দেখা যায় না।
হাইপোথাইরয়েডিজমে হার্টের ঝুঁকি বাড়ার আরেকটি কারণ হল লিপিডের (কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইড) মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া। এই লিপিড ধমনীর ভেতরের প্রাচীরে জমা হয়ে যা এথেরোসক্লেরোসিস সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। তাই উচ্চতর লিপিডযুক্ত ব্যক্তির থাইরয়েড সমস্যাগুলি পরীক্ষা ভাল। থাইরয়েড রোগের চিকিৎসা করলে অনেক সময় লিপিড প্রোফাইলিএমনিতেই ঠিক হয়ে যায়।
কিডনি রোগ
বেশ কিছু সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে কিডনির কার্যকারিতার উপর হাইপোথাইরয়েডিজমের প্রভাব রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ তাইওয়ানিজ প্রাপ্তবয়স্কদের উপর সম্পাদিত ২০১৮ সালে সায়েন্টিফিক রিপোর্ট জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
এখানে, এসটিমেইটিড গ্লোমেরুলার ফিলট্রেশন রেইট (ইজিএফআর) এবং সেইসাথে অংশগ্রহণকারীদের প্রস্রাবে প্রোটিনের মাত্রা দেখে পাওয়া যায় যে, হাইপোথাইরয়েডিজমে ভোগা ব্যক্তিদের স্বাভাবিক ব্যক্তিদের তুলনায় দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের ঝুঁকি প্রায় ৮ গুন( ৭.৬১গুন) বেশি।
এমনকি সাবক্লিনিক্যাল হাইপোথাইরয়েডিজম আছে এমন অংশগ্রহণকারী — যাদের TSH উচ্চতর কিন্তু থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিক — এদেরও কিডনি রোগ হওয়ার সম্ভাবনা ২ গুণ বেশি।
পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি
অনিয়ন্ত্রিত হাইপোথাইরয়েডিজম পেরিফেরাল স্নায়ুকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, যে স্নায়ুগুলো মস্তিষ্ক এবং মেরুদন্ড থেকে শরীরের বাকি অংশে তথ্য বহন করে। এর একটি কারণ হতে পারে পানি ধারণ, যা স্নায়ুর উপর অতিরিক্ত চাপ দেয়।
পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথির লক্ষণগুলির মধ্যে প্রায়ই বাহুতে বা পায়ে ব্যথা, অসাড়তা, বা ঝিঁঝিঁ ধরার মতো লক্ষণগুলো থাকে। এছাড়া পেশী দুর্বলতাও হতে পারে।
মানসিক বৈকল্য
হাইপোথাইরয়েডিজমের ক্ষেত্রে মানসিক বৈকল্য প্রায় দেখা যায়। অর্থাৎ কোন কিছু মনে রাখতে, নতুন জিনিস শিখতে, মনোনিবেশ করতে বা সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হয়।
এছাড়া হাইপোথাইরয়েডিজম বিষণনতাও সৃষ্টি করতে পারে। এন্ডোক্রাইন রিসার্চ জার্নালে প্রকাশিত ২০১৫ সালের একটি গবেষণার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে, সাবক্লিনিকাল হাইপোথাইরয়েডিজমে (অর্থাৎ যাদের TSH উচ্চতর কিন্তু থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিক ) আক্রান্ত ব্যক্তিদের বিষণ্নতা আছে কিনা তার উপর একটি পরীক্ষা করা হয়েছিল। পরে এদের একাংশকে থাইরয়েড হরমোন এবং অন্য অংশকে প্লাসিবো (মানে যা দেখতে হরমোনের মত কিন্তু তাতে কোন হরমোন নেই) ট্যাবলেট দেয়া হয়েছিল। ১২ সপ্তাহের পরে, থাইরয়েড হরমোন গ্রুপে বিষণ্নতার স্কোর উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হয়েছে, কিন্তু প্লাসিবো গ্রুপে নয়। অর্থাৎ থাইরয়েড হরমোন তাদের বিষণনতা মুক্ত করেছিল।
উর্বরতা সমস্যা
হাইপোথাইরয়েডিজমে আক্রান্ত অনেক মহিলার মাসিক অনিয়মিত হয় এবং আগে থেকে বোঝা যায় না যে কখন শুরু হবে। এটি উর্বরতার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
এন্ডোক্রাইন জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায়, সাবক্লিনিকাল হাইপোথাইরয়েডিজমে আক্রান্ত ৬৯ জন বন্ধ্যা মহিলাকে থাইরয়েড হরমোন দেওয়া হয়েছিল। এর পরে, ৮৪.১ শতাংশ সফলভাবে এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে গর্ভধারণ করেছিল।
মাইক্সেডিমা (কোমা)
হাইপোথাইরয়েডিজম যখন চরম পর্যায়ে যায় তখন মাইক্সেডিমা কোমা হতে পারে। যদিও খুব কম ক্ষেত্রে এটি ঘটে কিন্তু এর ফলে জীবন হুমকির সম্মুখীন হয়।