বিশ্বব্যাপী মুসলমানরা রমজান মাসে রোজা রাখে বা সিয়াম সাধণা করে যা মূলত: সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খাদ্য, পানীয়, যৌন সম্পর্ক এবং অন্যরা কষ্ট পায় এমন কথাবার্তা ও আচরণ থেকে বিরত থাকা। ১৪০০ বছর আগে মুসলমানরা রোজা রাখবার জন্য আদেশপ্রাপ্ত হয়েছিল। প্রাচীন গ্রীকরাও বিভিন্ন রোগ থেকে আরোগ্য পেতে উপবাস থাকার পরামর্শ দিতেন। বর্তমান পৃথিবীতে একদল বিজ্ঞানী বেশ জোরেশোরে রোজা রাখার বিভিন্ন উপকারিতার কথা বলছেন। তবে, তারা মুসলমানদের রোজার একটি পরিবর্তিত রূপের কথা বলছেন যাকে ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং বলা হচ্ছে এবং যেটি আসলে রোজার অনুরূপ একটি ধরণ। তাদের বিভিন্ন গবেষণায় উঠে আসতে শুরু করেছে যে, এই রোজার শারীরিক এবং মানসিক উভয় প্রকার বিষ্ময়কর উপকারিতা রয়েছে। ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এর কয়েকটি ধরণ থাকলেও প্রত্যেকের মূল বিষয়টা এক, তা হল দিনের (২৪ ঘণ্টা) একটি নির্দিষ্ট সময়ে খাবার বা পানীয় না খাওয়া তবে, পানি খাওয়াটা ঐচ্ছিক। যাইহোক, এর মূল বিষয়টা একদম রমজানের রোজার মতো। আর এটি বর্তমান বিশ্বে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় খাদ্যব্যবস্থা।
শুধু ওজন কমানো ছাড়াও রোজার অগণিত স্বাস্থ্য উপকারিতা আছে যেমন এটি উচ্চ রক্তচাপ ও কলেস্টেরল কমানোর সাথে সাথে ইনসুলিন এর প্রতি সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি করে। অতিমাত্রায় কার্ব ও চিনি খাওয়ার কারণে আমরা খুব কমবয়সে ইনসুলিন রেজিস্টেন্স এর মত মেটাবলিক ডিসঅর্ডারের স্বীকার হই। ইনসুলিন রেজিস্টেন্স এর ফলে শরীর সঠিকভাবে ইনসুলিন ব্যবহার করতে পারে না। এর ফলে জানা প্রায় সবগুলো ক্রনিক ডিজিজের সূত্রপাত ঘটে। কারো যদি উচ্চরক্তচাপ বা হৃদরোগ থাকে তবে তা ইনসুলিন রেজিস্টেন্স এর কারণে হতে পারে। যদি কারো অ্যালঝেইমার বা ডিমেনশিয়া থাকে যেক্ষেত্রে ব্রেইন ঠিকমত কাজ করে না। হতে পারে এর কারণ এই যে, তার ব্রেইন ইনসুলিন রেজিস্টেন্ট হয়ে গেছে। মেয়েদের ইনফার্টিলিটি সবথেকে বেশী যে কারণে হয়ে থাকে তা হল পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম যা ইনসুলিন রেজিস্টেন্স থেকে হয়। ইনসুলিন রেজিস্টেন্স এর কারণে ইনসুলিন স্বাভাবিক কিছু হরমোনের প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে, যা মেয়েদের ফার্টিলিটিতে কাজ করে। আর এরকম আরো অনেক ডিসওর্ডার আছে (যেমন- শরীরে চর্বি জমা, ফ্যাটি লিভার, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, সারকোপেনিয়া, মাইগ্রেইন, অস্টিওআর্থ্রাইটিস ইত্যাদি) যার কারণ ইনসুলিন রেজিস্টেন্স। অনেক সায়েন্টিস্ট মনে করেন রোজা রাখলে ইনসুলিন রেজিস্টেন্স দূর হয়ে শরীর ইনসুলিনের প্রতি সংবেদনশীল হয়।
যে সময়টিতে কোন খাবার গ্রহণ করা হয় না সেসময় আমাদের পুরো ডায়জেস্টিভ সিস্টেম বিশ্রাম নিতে পারে যেখানে লিভার, প্যানক্রিয়াস, অন্ত্রের মত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো রয়েছে। অন্ত্রের প্রাচীর এই অবসরে নিজের মেরামত করে নেয়। এছাড়া পুরো শরীরের কাজ এসময় কমে যায় বলে শরীর বরং দেহের বিষ নিষ্কাশনসহ বিভিন্ন আবর্জনা পরিস্কার করার কাজে মনোনিবেশ করে। কারণ, বেঁচে থাকবার জন্য এই কাজগুলো ভীষণ প্রয়োজন। বিষাক্ত উপাদান নিষ্কাশিত হবার আর একটি বড় কারণ হলো এসব উপাদানগুলো মূলত চর্বিতে জমা থাকে। রোজা থাকার ফলে শরীরের চর্বিকলা কমে গেলে বিষাক্ত উপাদনগুলোও শরীরের বাহিরে চলে যায়।
দীর্ঘ একমাস রোজা থাকার পর অনেকেরই চর্বির পাশাপাশি মাংশপেশীও কমে যায় যাকে কেউ কেউ ক্ষতিকর বিবেচনা করে। কিন্তু এসময় শরীর মূলত যে প্রোটিনগুলো শরীরের জন্য আবজর্নাস্বরূপ বা কমগুরুত্বপূর্ণ সেগুলো খরচ করে শক্তি উৎপাদন করে। অন্যদিকে যে প্রোটিনগুলো তরুণ, কর্মক্ষম ও বেঁচে থাকার জন্য অত্যাবশ্যকীয় তাদের ধ্বংস করে না।
রোজা থাকাকালীন আমাদের শরীর বিশেষ কিছু এনজাইম তৈরী করে যে এনজাইমগুলো শরীরের জন্য অপ্রয়োজনীয় কিংবা অপেক্ষাকৃত কম প্রয়োজনীয় প্রোটিনগুলো ভেঙ্গে প্রয়োজনীয় প্রোটিন তৈরী করতে কাজ করে। এতে করে ঐসময় জরুরী প্রোটিন বা এনজাইমের উৎপাদন অব্যাহত থাকে যা জীবনের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। পরে যখন খাবার খাওয়া হয় তখন শরীর দরকারী প্রোটিনগুলো পূনরায় প্রচুর পরিমাণে তৈরী করে।
উল্লেখ্য যে, রোজা রাখার সময় গ্রোথ হরমোনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। সুতরাং রোজা ভাঙ্গার পর যখন খাওয়া হয় তখন শরীর খাবারে বিদ্যমান পুষ্টি উপাদান দিয়ে তার ক্ষয়ে যাওয়া অংশটি পূরণ করে ফেলে। বলা যায় এসময় শরীরের রেনোভেশন বা নবায়ণ হয়।
এছাড়া, না খেয়ে থাকার সময়টিতে শরীর বিদ্যমান শক্তি ও পুষ্টি উপাদানগুলোকে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে খরচ করে, যাতে সামান্যতম শক্তি বা গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদানের অপচয় না হয়। অর্থাৎ শরীরের মেটাবলিক ফ্লেক্সিবিলিটি বা বিপাক নমনীয়তা বৃদ্ধি পায়। এতে শরীর যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারে। এই কাজগুলো করবার জন্য যাবতীয় মেকানিজম শরীরের মধ্যেই আছে। উদাহরণস্বরূপ কিটোসিসের কথা বলা যেতে পারে।
আমরা যারা শর্করাপ্রধান খাবার খেয়ে অভ্যস্ত তাদের ক্ষেত্রে শরীর মূলত গ্লুকোজকে ব্যবহার করে গ্লাইকোলাইসিস পদ্ধতিতে শক্তি উৎপাদন করে। অতিরিক্ত গ্লুকোজ চর্বি হিসেবে শরীরে জমা থাকলেও আমাদের শরীর প্রয়োজনের সময় এই চর্বি ব্যবহার করতে পারেনা। তাই, শরীরের চর্বি শুধু বৃদ্ধিই পায়; কমে না। কিন্তু রোজা রাখলে শরীরের ইনসুলিনের মাত্রা কমে যায় বলে শরীর কিটোসিসের মাধ্যমে সঞ্চিত চর্বি থেকে কিটোন তৈরী করে এবং এই কিটোন শক্তি উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়।
গ্লুকোজ অপেক্ষা কিটোন থেকে বেশী মেটাবলিক এনার্জি এবং তাৎপর্যপূর্ণভাবে কম ফ্রি রেডিক্যালস ও কম মেটাবলিক আবর্জনা তৈরী হয়। বিষয়টিকে একটি ভালো গাড়ীর সাথে তুলনা করা যেতে পারে যে গাড়ীটির পারফরমেন্স বেশ ভালো এবং কম গ্যাসে বেশী মাইল চলতে পারে কিন্তু তুলনামূলকভাবে কম ধোঁয়া ও কার্বন নিঃসরণ করে।
রোজা হৃদরোগ ও স্থূলতাকে প্রতিরোধ করার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যেরও উন্নতি ঘটায়। গবেষকরা রোজা রাখার সাথে অন্ত্রের স্বাস্থ্য ও মানসিক সুস্থতার সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন। রোজা থাকার সময় মস্তিষ্কে বিভিন্ন নিউরোট্রান্সমিটার ও ভালোবোধ হবার হরমোনের নিঃসরণ বৃদ্ধি পায় যা মস্তিষ্ককে সুরক্ষা প্রদান করে ও বিষন্নতা, দুঃশ্চিন্তাসহ স্মৃতিভ্রংশের মত সমস্যাগুলোকে প্রতিহত করে।
তবে রোজাকে ফলপ্রসূ করতে আমাদের ইফতার ও সেহেরির খাবারের মেনুটি একটু বুঝে শুনে নির্বাচন করতে হবে যেমন- মিষ্টিজাতীয় খাবার বাদ দেয়া, রিফাইনড কার্বহাইড্রেট (ময়দা বা চালের আটা) না খেয়ে বরং ভাত-রুটি খাওয়া, ফ্যাক্টরি বা প্রক্রিয়াজাত খাবার (কেনা জুস, পিৎজা ইত্যাদি) বাদ দিয়ে ঘরে বানানো খাবার খাওয়া, স্বাস্থ্যকর চর্বি বা তৈল খাওয়া। সকলপ্রকার রিফাইন্ড তেল যতটা সম্ভব কম খাওয়া।