আয়রনের সাথে আমরা কমবেশি পরিচিত হলেও “ফেরিটিন” শব্দটি আমাদের অনেকের কাছেই নতুন মনে হতে পারে। আয়রন হল শরীরের জন্য একটি অপরিহার্য খনিজ যা আমরা খাবারের মাধ্যমে গ্রহণ করি৷ আমাদের গ্রহণকৃত আয়রনের কিছু অংশ আমাদের শরীর ফেরিটিন আকারে সঞ্চয় করে।
ফেরিটিন মূলত: এক ধরনের প্রোটিন। এটি আয়রন সঞ্চয় করে যা শরীর প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারে। আমাদের রক্তে যদি কম ফেরিটিন থাকে তবে এর মানে হল আমাদের আয়রনেরও ঘাটতি রয়েছে।
যখন আমাদের শরীরে ফেরিটিন কমে যায়, তখন চুল পড়া লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এসময় যদি চুল পড়া ত্বরাম্বিত করে এমন অন্য কোন শারীরীক অবস্থা বিরাজ করে তবে ফেরিটিনের বিষয়টি ধরাছোঁয়ার বাহিরে থেকে যায়। আমরা সেই অন্য অবস্থাটিকেই চুল পড়ার জন্য দায়ী বলে ধরে নেই।
তবে, ফেরিটিন পরীক্ষা ডাক্তারকে চুল পড়ার সঠিক চিকিতসা করতে সাহায্য করে। এটি মূলত: শরীরে আয়রনের সঠিক মাত্রা পরিমাপের জন্য করা হয়।
ফেরিটিন এর সাথে চুল পড়ার সকম্পর্ক
শরীরের অনেক অংশে যেমন প্লীহা, যকৃত, রক্ত এবং চুলের ফলিকল এ ফেরিটিন প্রোটিন জমা থাকে। যখন শরীরে আয়রনের প্রয়োজন পড়ে তখন ফেরিটিন প্রোটিন ভেঙ্গে আয়রন সরবরাহ করে।
অনেক প্রয়োজনীয় শারীরিক প্রক্রিয়ায় আয়রন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আয়রন ছাড়া শরীর যথেষ্ট পরিমাণে লোহিত রক্তকণিকা তৈরি করতে পারে না।
লোহিত রক্তকণিকা শরীরের সকল কোষে অক্সিজেন পরিবহন করে। যখন রক্তে লোহিত রক্তকণিকা কমে যায়, তখন শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ এবং টিস্যুতে অক্সিজেন পরিবহনে অসুবিধা হয়। এটি চুল পড়া সহ বিভিন্ন সমস্যার কারণ হতে পারে।
একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে সাধারণভাবে, যাদের চুল পড়েনি তাদের তুলনায় যারা চুল পড়ার সম্মুখীন হয়েছেন তাদের আয়রনের মাত্রা কম ছিল।
আর একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, চুল পড়ে যাওয়া মহিলাদের রক্তে ফেরিটিনের মাত্রা কম ছিল, যা তাদের আয়রনের ঘাটতির জন্য সৃষ্টি হয়েছিল।
আয়রনের মাত্রা কমে যাওয়ায় কেন চুল পড়ে তার আর একটি ব্যাখ্যা হল, যখন শরীরে আয়রনের পরিমাণ কম থাকে, তখন এটি শরীরের অন্য কোথাও জরুরী কাজে ব্যবহারের জন্য চুলের ফলিকলে সঞ্চিত ফেরিটিন ভেঙ্গে আয়রন গ্রহণ করে। এতে চুলের ফলিকলে ফেরিটিনের মাত্রা কমে যাওয়ায় চুল নিজেই দুর্বল হয়ে পড়ে এবং চুল পড়ে যেতে পারে।
আয়রন একটি অপরিহার্য পুষ্টি, এবং শরীর এটি তৈরি করতে পারে না। এটি সম্পূর্ণরূপে খাদ্যের মাধ্যমে পেতে হবে। যারা পর্যাপ্ত আয়রন-সমৃদ্ধ খাবার খান না তাদের ফেরিটিনের মাত্রা কম হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
আয়রনের মাত্রা কম হওয়ার একটি কারণ খাবার। অন্যান্য কারণ এর মধ্যে আছে:
- ভারী পিরীয়ড
- অন্য কোন কারণে রক্ত ক্ষরণ
- গর্ভাবস্থা
- হাইপারথাইরয়েডিজম
- সিলিয়াক রোগ বা গ্লুটেন অসহিষ্ণুতা
কম ফেরিটিনের লক্ষণগুলি কী কী?
ফেরিটিন এর কম উপস্থিতি শরীরে লোহিত রক্ত কনিকা তৈরীতে ব্যাঘাত ঘটায়। এই বিশেষ রক্ত কনিকাটি যেহেতু শরীরে অক্সিজেন স্থানান্তরের সাথে সম্পর্কিত তাই এর অভাবে আমাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গ এবং প্রধান সিস্টেমগুলি কার্যকরভাবে কাজ করতে পারে না।
কম ফেরিটিনের লক্ষণগুলি আয়রনের ঘাটতির মতোই। চুল পড়া তাদের একটি লক্ষণ মাত্র। অন্যান্য লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- মাথা ঘোরা
- ক্লান্তি
- কানে ভোঁ ভোঁ শব্দ
- ভঙ্গুর নখ
- শ্বাসকষ্ট
- মাথাব্যথা
- মনোনিবেশ করতে অসুবিধা
- রেস্টলেস লেগ বা অস্থির পা
ফেরিটিনের মাত্রা বৃদ্ধি
ফেরিটিন এর মাত্রা বৃদ্ধি করতে প্রয়োজন আয়রনের মাত্রা বৃদ্ধি করা। যদি আমরা পর্যাপ্ত আয়রন সমৃদ্ধ খাবার (যেমন লিভার এবং গরুর মাংস) খেতে না পারি তবে সেক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ ক্রমে আয়রন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা যেতে পারে।
মাংসে উদ্ভিদ-ভিত্তিক খাবারের তুলনায় উচ্চ মাত্রার আয়রন থাকে। তথাপি, গোটা শস্য, ডাল বা বীজ জাতীয় খাবার, বাদাম ইত্যাদি থেকে কিছুটা আয়রন পাওয়া যেতে পারে। মনে রাখা ভালো যে এসব আয়রন-সমৃদ্ধ খাবারের সাথে ভিটামিন সি-সমৃদ্ধ খাবার যেমন- লেবু, কাঁচামরিচ ইত্যাদি খেলে শরীর আরও ভালোভাবে আয়রন শোষণ করতে পারে।
যদি কোন বিশেষ খাবারের প্রতি সংবেদনশীলতা থাকে সেক্ষেত্রে রক্ত পরীক্ষা করা যেতে পারে অথবা একটি এলিমিনেশন ডায়েট গ্রহণ করা যেতে পারে।
গ্লুটেন ইনটলারেন্স এর কারণে আয়রনের শোষণ কম হয় যা পরবর্তীতে ফেরিটিনের মাত্রা কমায় এবং চুল পড়া বৃদ্ধি করে। গ্লুটেন হলো গমসহ বিভিন্ন খাদ্যশস্যে থাকা একটি বিশেষ প্রোটিন।
ফেরিটিনের অভাবে যদি চুল পড়ে যায় তবে আয়রনের ঘাটতি মেটানো হলে চুল আবার বৃদ্ধি পাবে। তবুও, চুল পুনরায় গজাতে বেশ কয়েক মাস সময় লাগতে পারে, তাই ধৈর্য্যই মুখ্য।
ঝুঁকি এবং সতর্কতা
আয়রন ট্যাবলেট গ্রহণের ক্ষেত্রে সঠিক মাত্রা বজায় রাখতে হবে। কারণ, অত্যধিক আয়রন বিপরীত প্রভাব ফেলতে পারে। তবে, প্রাকৃতিক খাবার গ্রহণের ফলে আয়রনের মাত্রা অত্যধিক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
সাধারণ ফেরিটিন এর হার মহিলাদের জন্য প্রতি মিলিলিটারে 20 থেকে 200 ন্যানোগ্রাম এবং পুরুষদের জন্য 20 থেকে 500।
এমনকি যদি আপনার কম ফেরিটিন থাকে তবে খুব বেশি আয়রন গ্রহণ করা সমস্যাযুক্ত হতে পারে। কম ফেরিটিন কিন্তু স্বাভাবিক আয়রন রিডিং থাকাও সম্ভব।
আয়রন ওভারডোজ একটি বড় সমস্যা। এর ফলে
- পেটে ব্যথা
- কালো বা রক্তাক্ত মল
- বমি
- বিরক্তি
- হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি
- রক্তচাপ হ্রাস হতে পারে।
আয়রন ওভারডোজ থেকে লিভার ফেইলার হতে পারে। তাই, কম ফেরিটিনের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত আয়রন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা উচিত নয়।