বাড়তি ওজন চলাফেরার জন্য খুব একটা আরামদায়ক নয়। তাই বাড়তি ওজন বহনকারী একটু অস্বস্তিতে থাকতেই পারেন। তবে যারা স্থূলকায় তারা মনে করেন তাদের অস্বস্তির মূল কারণ তাদের বাড়তি ওজন নয়, বরং তাদের বাড়তি ওজনের প্রতি সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। বাড়তি ওজন তখন বলি যখন কারো বিএমআই ২৫-এর বেশি হয়। বিএমআই হলো কেজিতে প্রকাশিত আপনার ওজনকে মিটারে প্রকাশিত আপনার উচ্চতার বর্গ দিয়ে ভাগফল।
ধরে নিলাম বিএমআই বিবেচনায় আপনার ওজন অনেক বেশি। কিন্তু এরপরও আপনি আপনার বিপাক কার্যক্রমের বিবেচনায় সুস্থ হতে পারেন। আবার কারো বিএমআই ফলাফল একদম ঠিকঠাক হওয়ার পরও তার বিপাক কার্যক্রম ঠিক নাও থাকতে পারে, অর্থাৎ তিনি অসুস্থ হতে পারেন। তাই ওজন একটি সম্পূর্ণ চিত্র নয়।
কিন্তু গবেষণায় দেখা যায় বিএমআই যাদের বেশি (মানে ওজন বেশি) তারা সুস্থ বা অসুস্থ যা-ই হোন না কেন, তারা বিএমআই যাদের কম (মানে ওজন কম) তাদের অপেক্ষা তুলনামূলকভাবে কম উপার্জন করেন। এটি বেশি সত্যি মেয়েদের ক্ষেত্রে। এর কারণ, আমরা একজন স্থূলকায় মানুষকে আকর্ষণীয় ভাবি না। আর তাই তাকে বেশি পারিশ্রমিক দিতে আগ্রহী
হই না।
এভাবে, আমরা অবচেতনভাবে একজন স্থূলকায় মানুষের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করি, যা আমরা নিজেরাও বুঝি না। তাদের সম্পর্কে অনিচ্ছাকৃতভাবে আমরা ভাবি যে, তারা অলস হবেন, পেটুক হবেন এবং তারা খুব একটা উদ্যমী হবেন না। আর আমাদের এই চিন্তা তৈরি করার পেছনের কারিগর হলেন সেসব চিকিৎসক ও গবেষক, যারা মনে করেন মানুষ বেশি খেলে মোটা হয় আর কম খেলে হালকা-পাতলা হয় অর্থাৎ একজন ব্যক্তি মোটা হবেন না হালকা-পাতলা হবেন তা নির্ভর করে কতটুকু ক্যালরি তিনি গ্রহণ করছেন তার ওপর।
যখন সারাবিশ্বে ৩০ ভাগ মানুষ ভয়াবহভাবে স্থূল হয়ে গেছে তখনো সেসব চিকিৎসক ও গবেষক দোষ দিচ্ছেন সেই ব্যক্তিবর্গকেই। তাদের মতে একজন মানুষ তার ইচ্ছাশক্তির অভাবেই স্থূলকায় হয়। সে খেতে ভালোবাসে বলেই সে স্থূলকায়। সে যা খায় তা পরিশ্রম করে শক্তি খরচ করে না বলেই সে স্থূলকায়। তার মানে এই দাঁড়াল যে, বর্তমান পৃথিবী যে স্থূলতা সমস্যায় ভুগছে তা মূলত সামগ্রিক ইচ্ছাশক্তির অভাবের ফল। অর্থাৎ এটা কোনো শারীরিক সমস্যা নয়, বরং এটি একটি চারিত্রিক সমস্যা।
সুতরাং আপনি যদি স্থূলকায় হন তাহলে আমি ধরেই নিতে পারি যে, আপনার চারিত্রিক দৃঢ়তা নেই বললেই চলে। কারণ, সেটা থাকলে তো আর আপনি স্থূলকায় হতেন না। আমেরিকার ৭০ ভাগ মানুষের ওজন স্বাভাবিকের থেকে বেশি। অতএব, বুঝতেই পারছেন, সারা পৃথিবীকে পায়ের নিচে দাবিয়ে রাখা আমেরিকানদের ৭০ ভাগই চারিত্রিক দৃঢ়তার অভাবে ভোগে। এই কথাটি যেমন বোগাস শোনাচ্ছে ঠিক তেমনই বোগাস ধারণা হলোÑকম খান বেশি পরিশ্রম করেন, ওজন ঠিক থাকবে।
আমরা স্থূলকায় মানুষদের যে টিপসগুলো দিচ্ছি তা আমেরিকানরা ১৯৭০ থেকে অনুসরণ করছে। তারপরও তাদের বেশি ওজনসম্পন্ন মানুষের শতকরা হার ১৫ থেকে বেড়ে ৭০-এ গেছে। তারপরও কি অন্ধের মতো হাইকোর্ট দেখব নাকি সঠিক বিজ্ঞান জানতে সচেষ্ট হব?
ওজন কমানো নিয়ে একটা বিলিয়ন ডলার ব্যবসা চলমান আছে। তবে তার সিংহ ভাগই ফেইক বা ভুয়া। অনেকেই ওজন কমানোর অনেক প্রোডাক্ট ও সার্ভিস নিয়ে বাজারে বসে আছেন। স্বল্পমেয়াদে সেসব প্রোডাক্ট বা সার্ভিস কিছুটা কাজে এলেও দীর্ঘমেয়াদে তাদের প্রায় সবারই সফলতা শূন্যের কোঠায়। অর্থাৎ শরীরের ওপর অত্যাচার চালিয়ে খুব কম সময়ে ওজন কিছুটা কমিয়ে ফেললেও দু-চার বছর পর ওজন আবার তার আগের জায়গায় ফিরে আসে এবং কখনো কখনো আগের থেকেও বেশি হয়ে যায়।
এখন মনে হতে পারে, বেশ তো অন্তত দু-চার বছর তো কম-ওজনটাকে উপভোগ করা গেছে। কিন্তু, কথা হচ্ছে এই অত্যাচার শরীরের অনেক ক্ষতি করে দিয়ে গেছে। শরীরের হোমিওস্ট্যাসিস বা ব্যালান্স নষ্ট করে দিয়েছে, ইমিউন সিস্টেমকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে গেছে, অর্থাৎ সে প্রয়োজনে কাজ করছে না, অথচ অপ্রয়োজনে কাজ করছে। শরীরের বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কর্মকা-ের থ্রেশল্ডের পরিবর্তন করে গেছে, যেমনÑআগে শরীর যে হারে চর্বি সঞ্চিত করত এখন তার চেয়ে বেশি হারে করছে। সামগ্রিকভাবে শরীরকে ইমার্জেন্সি মোডে নিয়ে গেছে, অর্থাৎ যে পরিস্থিতিতে সে শুধু শক্তি সঞ্চয় করে রাখাকেই মূল কাজ মনে করে। আর এমন একটি অবস্থায় শরীর চলে গেলে তখন স্থূলকায় মানুষগুলো অধিক ওজনের পাশাপাশি মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে বিভিন্ন প্রকার লাইফ স্টাইল ডিজিজে আক্রান্ত হবে, যার মধ্যে টাইপ-২ ডায়াবেটিস, আথ্রাইটিস, হার্ট ডিজিজ উল্লেখযোগ্য।
এত কিছু না করে যদি শুধু নিজেকে প্রশ্ন করি যে, আমার কতটুকু খাবার প্রয়োজন? কোনগুলো খাবার? আর কোনটা খাবার সময়? সঠিক উত্তরগুলো যদি জানি তবে কোনো প্রোডাক্ট ও সার্ভিস লাগবে না। আমরা নিজেরাই নিজেদের ওজনটা কমিয়ে ফেলতে পারি। বেশির ভাগ মানুষেরই উত্তরগুলো জানা। যাদের জানা নেই তাদের জন্য উত্তরগুলো নিচে আছে।
আমার কতটুকু খাবার প্রয়োজন?
ক্যালরি হিসেবে ১৮০০ থেকে ২০০০ ক্যালরি, যদিও কাজের ভিত্তিতে কিছুটা কম-বেশি হয়। তবে ক্যালরি গোনা অনেকেরই হয়ে ওঠে না। তাদের জন্য বলতে পারি, একজন ডায়াবেটিস রোগীর তিন বেলা (স্ন্যাক বাদে) খাবারের যে তালিকা ও পরিমাণ আছে, তা একটি সুস্থ-সবল মানুষের জন্য যথেষ্ট। তবে ডায়াবেটিস না থাকলে পর্যাপ্ত ফলমূল খেতে বাধা নেই।
কোনগুলো খাবার?
যা প্রাকৃতিক এবং যা নিরাপদ শুধু সেগুলোই খাবার। আর অন্যগুলো আমাদের শরীরের জন্য বিষতুল্য। সেই হিসেবে সকল ফ্যাক্টরিজাত খাবার, চিনি এবং লবণও কিছুটা অপ্রাকৃতিক। আর যেকোনো ভালো প্রাকৃতিক খাবারও যখন প্রয়োজনের বেশি হয়ে যায় তখন তা অনিরাপদ হয়ে যায়। এমনকি পানি পর্যন্ত।
কোনটা খাওয়ার সময়?
দিনের শুরু (সকাল ১০টার মধ্যে) এবং দিনের শেষ (রাত ৮টার মধ্যে) খাবারের উৎকৃষ্ট সময়। এর মাঝে আর খাবারের কোনো প্রয়োজন নেই। তবে চাইলে দুপুরে এক প্লেট সালাদ খাওয়া যেতে পারে। নাস্তা খাওয়ার বদভ্যাস থেকে নিজেকে বিরত করতে না পারলে ভবিষ্যতে হাজারো শারীরিক জটিলতায় ভোগার প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। প্রতি ৩-৪ ঘণ্টা পরপর পাকস্থলীতে খাবার পৌঁছানোর কোনোই প্রয়োজন নেই। সঠিক সময়ে সঠিক খাবার গ্রহণ করলে দিনে ৩ বার বা ২ বার খাবার গ্রহণই যথেষ্ট। কারণ, সারাদিন খাবার গ্রহণ করলে তা আমাদের অগ্ন্যাশয় ও পরিপাকতন্ত্রের ওপর বাড়তি চাপ ফেলে। আর একসময় কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তখন পাকস্থলী অনেক গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যোপাদান শোষণে ব্যর্থ হয়, যা থেকে বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগের সৃষ্টি হয়।
এ ছাড়া ঘন ঘন খাবার গ্রহণের ফলে, সেই খাবারকে সঠিকভাবে ব্যবহার করবার জন্য অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন নিঃসৃত হয়ে রক্তে উপস্থিত হয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, অনেক কাজের মধ্যে ইনসুলিনের একটি কাজ হচ্ছে শরীরের চর্বিকে খরচ হতে বাধা প্রদান করা। তাই এই ইনসুলিন যাতে রক্তে সবসময় থাকতে না পারে সেভাবে আমাদের খাবার গ্রহণের অভ্যাস তৈরি করতে হবে। ভালো উপায় হলো, দিনে তিনবারের বেশি কোনো খাবার গ্রহণ না করা। দুইবার হলে বেশি ভালো। যদি কোনো বিশেষ স্ন্যাক খেতে ইচ্ছে করে তবে তা সকাল, দুপুর বা রাতের খাবারের সাথে গ্রহণ করা, অন্য সময় কোনোভাবেই নয়। আর যদি সম্ভব হয় মাঝে মাঝে রোজা রাখা। কারণ, রোজা আমাদের শরীরের চর্বি খরচের সুযোগ তৈরি করে দেয়।
এই উত্তরগুলো জানলে এবং মানলে কারো বাড়তি ওজন থাকার কথা নয়। আর এরপরও যদি থাকে তবে অবশ্যই চিকিৎসকের দ্বারস্থ হতে হবে এটা জানতে যে আপনার হরমোনাল কোনো অসাম্যতা আছে কি না।
আর একটি কথা, শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে, দিনে ৮ ঘণ্টা ঘুমাতে হবে, মানসিক চাপকে জয় করতে হবে স্থূলকায় বা শীর্ণকায় প্রত্যেককেই। এগুলো করতে হবে ওজন কমানোর জন্য না, বরং সুস্থ থাকার জন্য।