আমাদের গলার সামনের দিকে প্রজাপ্রতির মতো দেখতে একটি গ্ল্যান্ড বা গ্রস্থি আছে। এটিই থায়রয়েড গ্ল্যান্ড। এই গ্ল্যান্ডটি ৩টি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ হরমোন উৎপাদন করে- টি৩ (T3 ), টি৪ (T4) এবং ক্যালসিটোনিন।
T3 এবং T4 হরমোন দুটি আপনার শরীর কীভাবে শক্তি ব্যবহার করবে তা নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া এই হরমোনগুলি আপনার ওজন, শরীরের তাপমাত্রা, পেশী শক্তি এবং স্নায়ুতন্ত্র নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
থাইরয়েড গ্রন্থি দ্বারা উৎপাদিত তৃতীয় হরমোনকে ক্যালসিটোনিন বলা হয়। এটি শরীরে ক্যালসিয়াম ব্যবহারের সাথে জড়িত।
থাইরয়েড গ্রন্থি যখন স্বাভাবিকের তুলনায় কম সক্রিয় থাকে তখন তাকে হাইপোথাইরয়েডিজম হিসাবে উল্লেখ করা হয়। হাইপোথাইরয়েডিজম বোঝার সবচেয়ে সহজ উপায় হল এর শাব্দিক অর্থ বিবেচনা করা:
হাইপো মানে খুব কম
থাইরয়েডিজম মানে থাইরয়েডের একটি রোগ
অতএব, হাইপোথাইরয়েডিজম = খুব কম থাইরয়েড কার্যক্রমের ফলে সৃষ্ট রোগ
বিভিন্ন করনে হাইপোথাইরয়েডিজম হতে পারে অর্থাৎ থাইরয়েড গ্ল্যান্ড কম পরিমান হরমোন উৎপাদন করতে পারে যেমন, অটোইমিউন ডিজিজ, ইনফ্লামেশন বা থাইরোডাইটিস, আয়োডিনের অভাব এবং কখনও কখনও কোন ওষুদের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। হাইপোথাইরয়েডিজম এর ৯টি গুরুত্বপূর্ণ ক্লিনিক্যাল উপসর্গ নিচে দেয়া হল।
অ্যাস্টিয়াটোটিক একজিমা: এটি একটি সাধারণ ধরনের ডার্মাটাইটিস যা শুষ্ক ত্বকের ফলে ঘটে। এর ফলে ত্বকের উপরের দিকে ফেঁটে যায় । ত্বকের ফেটে যাওয়া অংশ দিয়ে পানি জলীয় বাষ্পাকারে উড়ে যাওয়ার ফলে ফাটার তীব্রতা বেড়ে যায়। এটি বেশি হয় শীতকালে যখন বাতাতে জলীয় বাষ্প কম থাকে। এবং এটি পঞ্চাশোর্ধদের বেশি হয়ে থাকে। এটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জংঘা বা নিচের পায়ের সামনের অংশে দেখা গেলেও শরীরের অন্যান্য অংশ যেমন, বুক, পিঠ, হাতের কুনুই ইত্যাদি যায়গায়ও হতে পারে।
মোটা ও রুক্ষ ত্বক: থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা কম থাকায় ত্বক পুরু ও রুক্ষ হয়ে যেতে পারে। ত্বক রুক্ষ হওয়ার ক্ষেত্রে কম ঘাম নির্গত হওয়াকে দায়ী করা হয়। তবে কেন দীর্ঘদিন হাইপোথাইরয়েডিজমে ভুগলে কম ঘাম হয় তা স্পষ্ট নয়।
ক্যারোটিনোডার্মা: এটি এমন একটি অবস্থা যাতে ত্বকে অতিরিক্ত β-ক্যারোটিন জমা হয়, যার ফলে ত্বক ফ্যাকাশে বা হলুদ দেখায়। β-ক্যারোটিন উদ্ভিব্জ খাবারে পাওয়া যায় যেমন গাজর। β-ক্যারোটিন শরীরে প্রবেশ করে ভিটামিন-এ তে রুপান্তরিত হয় আর এই প্রক্রিয়াকে ত্বরাম্বিত করে থাইরয়েড হরমোন। যদি থাইরয়েড হরমোন এর উৎপাদন কম হয় তবে β-ক্যারোটিন এর ভিটামিন-এ তে রুপান্তর হওয়ার মাত্রা কমে যাবে, ফলে β-ক্যারোটিন শরীরে জমা হতে থাকবে এবং ক্যারোটিনোডার্মা সৃষ্টি করবে। তবে ডায়াবেটিস, লিভার ডিজিজ এবং কিডনী ডিজিজ এর ফলেও ক্যারোটিনোডার্মা দেখা যায়। এটিকে জন্ডিসের সাথে গুলিয়ে ফেলা ঠিক হবে না।
চুল পড়ে যাওয়া এবং ভঙ্গুর হওয়া: চুল মোটা এবং ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। মুঠো মুঠো চুল উঠে । ভ্রুরু এর এক তৃতিয়াংশের চুল পড়ে যায়।
ভঙ্গুর নখ: নখ ধীরে ধীরে বাড়ে, অনমনীয় হয় এবং সহজেই ভেঙে যেতে পারে।এর সম্ভাব্য কারণ হল, থাইরয়েড হরমোনের অভাবে শরীরের সবধরণের কোষের বৃদ্ধিই ব্যহত হয়। এতে নতুন ত্বক কোষ তৈরী হয় না, চুল এবং নখের বৃদ্ধি দেরীতে হয়। একই কারণে কেরাটিন কোষ জমা হয়ে নখে খাঁজ তৈরী করে।
মিক্সিডিমা: দীর্ঘদিন হাইপোথাইরয়েডিজম এ ভুগলে এটি ঘটে যার ফলে চোখের পাতা ফুলে যায়, পায়ের পাতার ত্বক বা হাতের ত্বক অস্বাভাবিকভাবে মোটা হয়ে যায়। মূলত: ত্বকের কোষকলা জমে ফুলে উঠে।
মুখমন্ডল ফুলে যাওয়া: চোখ ও মুখ ফুলে যায়।
ক্ষতের বিলম্বিত নিরাময়: হাইপোথাইরয়েডিজম এ ভুগলে ক্ষত নিরাময়ের সময় টাইপ-৪ কোলাজেন এবং হাইড্রোক্সিপ্রোলিনের অভাবে দ্রুত ক্ষত শুকায় না।
ঠান্ডা সহ্য না হওয়া: হাইপোথাইরয়েডিজম বিপাক বা মেটাবলিজমকে ধীর করে দিতে পারে। যার ফলে শরীরের মূল তাপমাত্রা কমে যেতে পারে। যেমন, থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা কম আছে এমন কিছু লোকের সারাক্ষণ ঠান্ডা অনুভব হতে পারে বা ঠান্ডা সহ্য করার ক্ষমতা কমে যেতে পারে। এমনকি গরমের দিনেও এটা অব্যাহত থাকতে পারে।
এছাড়া, হাইপোথাইরয়েডিজম এর কারণে ভারী ঋতুস্রাব, বন্ধাত্ব, ইরেক্টাইল ডিসফাংশন, স্লিপ এ্যাপনিয়া, ফেঁসফেঁসে কন্ঠ, কৌষ্ঠকাঠিন্য, মনোনিবেশ না করতে পারা, ক্লান্তি, ওজন বৃদ্ধি এবং হতাশার মতো উপসর্গগুলিও দেখা যেতে পারে। এক্ষেত্রে মনে রাখা উচিৎ, শুধুমাত্র একটি বা দুটি উপসর্গ থাকা মানে এই নয় যে আপনার হাইপোথাইরয়েডিজম আছে।
Photo: Cleveland clinic
See insights and ads