আমরা যখন আমাদের সারকাডিয়ান রিদম-এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের দৈনন্দিন কাজগুলো (ঘুমানো, জেগে থাকা, খাওয়া ইত্যাদি) করে থাকি তখন আমাদের শরীর তুলনামূলকভাবে বেশি লাভবান হয়। সারকাডিয়ান রিদম হচ্ছে শরীরের ২৪ ঘণ্টার একটি চক্র, যা আমাদের বলে দেয় কখন আমরা জেগে থাকব, কখন ঘুমাব বা কখন আমরা খাব। একে দেহঘড়ি বলা যেতে পারে। এই রিদম বা ছন্দের বাইরে গিয়ে আমরা যখন আমাদের কাজগুলো করি তখন শরীর ওজন বৃদ্ধি বা মেটাবলিক ডিসঅর্ডারের মতো সমস্যায় পড়ে।
সারকাডিয়ান রিদম বিশেষজ্ঞরা বলছেন ৮-১০ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে খাবার গ্রহণ সীমাবদ্ধ রেখে আমরা আমাদের মেটাবলিক বা বিপাকীয় স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে পারি। যেমনÑদিনের প্রথম খাবারটি খেতে হবে সকালে এবং শেষ খাবারটি খেতে হবে সন্ধ্যায়।
এই ধারণাটি যে বিষয়টি থেকে এসেছে তা হলো, আমাদের বিপাকক্রিয়া একটি ছন্দে কাজ করে। যেমনÑসকালে ও সন্ধ্যায়, অন্যান্য সময়ের তুলনায় দেহের বিভিন্ন হরমোন, এনজাইম ও পরিপাকব্যবস্থা সবচেয়ে বেশি কর্মক্ষম থাকে। বাস্তবে দেখা যায় বেশির ভাগ মানুষই সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে রাতে শোবার আগ পর্যন্ত প্রায় ১৫-১৬ ঘণ্টাব্যাপী ভারী ও হালকা বিভিন্ন ধরনের খাবার গ্রহণ করেন। এই খাবার গ্রহণের ধরনটি আমাদের শরীরের ছন্দের সাথে মোটেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
মানুষের মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসে দেহের মূল ঘড়ি আছে, তা মানুষ অনেক আগে থেকেই জানত। এই ঘড়িটি আলোর উপস্থিতির ওপর ভিত্তি করে ঘুম-জাগ্রত চক্রকে পরিচালনা করে। অর্থাৎ আলোর উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সে শরীরকে নির্দেশনা দেয় কখন শরীর জেগে থাকবে আর কখন ঘুমিয়ে। তবে মাত্র দুই দশক আগে বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন যে, মানুষের শরীরে শুধু একটি ঘড়ি নয়, বরং অনেকগুলো ঘড়ি বিদ্যমান। প্রত্যেকটি অঙ্গেরই নিজস্ব ঘড়ি আছে, যা তার ২৪ ঘণ্টার কাজের চক্রকে নিয়ন্ত্রণ করে। যেমনÑদিনের বেলা অগ্ন্যাশয় সর্বাপেক্ষা কর্মক্ষম থাকে এবং বেশি বেশি ইনসুলিন উৎপাদন করে, যা রক্তের গ্লুকোজকে নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং রাতে এর উৎপাদন ধীরে ধীরে কমতে থাকে।
একইভাবে অন্ত্রেরও একটি ঘড়ি আছে, যা এনজাইম নিঃসরণের জোয়ার-ভাটা, পুষ্টি উপাদানের শোষণ এবং বর্জ্যদ্রব্যের অপসারণ নিয়ন্ত্রণ করে। এমনকি অন্ত্রে যে কোটি কোটি অণুজীব থাকে এরাও একটি প্রাত্যহিক ছন্দে কাজ করে। আর এই ছন্দগুলো ভীষণ দৃঢ় ও নিগূঢ় কারণ এটি আসলে আমাদের ডিএনএ-তে উপস্থিত। গবেষণায় উঠে এসেছে যে, প্রতিটি অঙ্গেই একগুচ্ছ জিন একসাথে প্রোটিন উৎপাদন করে এবং একই সাথে আবার উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। অর্থাৎ তারা একটি নিয়ম মেনে প্রকাশিত হয়, যাকে আমরা ছন্দ বলছি। কেননা এটি প্রতিদিন একই নিয়মে চলে।
মানুষ এই পৃথিবীতে হাজার হাজার বছর ধরে বসবাস করছে। এই হাজার হাজার বছরে অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে, যেমনÑআবহাওয়া পরিবর্তন হয়েছে, খাবারের প্রাপ্যতা ও ধরনের পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু একটি জিনিস সবসময় অপরিবর্তিত ছিল তা হলো, রোজ সকালে সূর্য যথারীতি পূর্ব দিকে উঠেছে এবং সন্ধ্যায় তা অস্ত গেছে। তাই আমাদের শরীরটা এই ২৪ ঘণ্টার একটি চক্রের সাথে একাত্ম হয়ে গেছে। বিপাক যার বাইরে নয়। সারা রাতের ঘুম শেষে প্রতি সকালে আমাদের মস্তিষ্ক যেমন সকল অবসাদ কাটিয়ে পুনরায় কর্মক্ষম হয়ে ওঠে তেমনি প্রত্যেকটি অঙ্গেরই এমন একটি বিশ্রাম সময় প্রয়োজন হয় তার পূর্ণশক্তি ফিরে পেতে।
বেশির ভাগ প্রমাণই বলে যে দিনের প্রথম ভাগে দিনের বেশির ভাগ খাবার গ্রহণ স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। কয়েক ডজন গবেষণা বলছে গ্লুকোজ সকালে যতটা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় রাতে ততটা নয়। সকালে আমাদের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জাগ্রত অবস্থায় থাকে বলে এ সময় শরীরে বেশি শক্তি খরচ হয়, তাই খাবারও ভালো হজম হয়। রাতে সূর্যের আলোর অনুপস্থিতিতে আমাদের মস্তিষ্ক মেলাটোনিন নামে একটি হরমোন নিঃসৃত করে, যা পুরো শরীরকে ঘুমন্ত দশায় যেতে কাজ করে।
যখন আমরা রাতে দেরি করে খাই তখন এর মাধ্যমে শরীরের খাবার প্রক্রিয়াকারী বিভিন্ন অঙ্গকে এই সিগন্যাল দেয়া হয় যে এখনো দিন চলছে। অর্থাৎ এ সময় শরীরের বিভিন্ন ঘড়ি পরস্পরবিরোধী সিগন্যাল পায়। এভাবে যদি আমরা দীর্ঘদিন যাবৎ উজ্জ্বল আলোর অনুপস্থিতিতে খাবার খাই তাহলে আমাদের শরীরের বিভিন্ন ঘড়ির মধ্যে সমন্বয়হীনতার সৃষ্টি হয় এবং এতে শরীরের বিপাকক্রিয়া একটি বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে। কোষীয় কার্যক্রমে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন উপাদানের উৎপাদন বৃদ্ধি করবে না কমিয়ে ফেলবে তার সুস্পষ্ট সিগন্যাল শরীর পায় না।
মূল ঘড়িটি নষ্ট করে ফেললে কেমন প্রতিক্রিয়া হয় তা আমরা বুঝি যখন আমরা আকাশপথে যাত্রা করে ভিন্ন টাইম জোনে যাই। অর্থাৎ যে সময়টা আমাদের দেশে রাত সে সময়টা হয়তো আমাদের গন্তব্যস্থলে দিন। কিন্তু সে দিনে আমরা রাতের মতো ক্লান্ত বোধ করি বা অবসাদগ্রস্ত হই, মস্তিষ্ক ঠিকমতো কাজ করে না, সে রাতের বিশ্রাম প্রত্যাশা করে ইত্যাদি। ইংলিশরা একে জেট ল্যাগ বলে। ভুল সময়ে খাবার গ্রহণ খাবার হজমকারী বিভিন্ন অঙ্গে অনুরূপ একটি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। কারণ এদেরকে সেই সময়ে কাজ করতে বলা হয়, যা তাদের জন্য বিশ্রামের সময়। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর অ্যাপিজেনেটিক অ্যান্ড মেটাবলিজমের ডিরেক্টর বলেন, এই অবস্থা অনেক ধরনের রোগ সৃষ্টি করতে পারে। তার মতে, দীর্ঘদিন যাবৎ নাইট শিফটে কাজ করা মানুষগুলো এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। দেখা যায় এসব লোকদের স্থূলতা, ডায়াবেটিস, কিছু ক্যানসার এবং হৃদরোগের প্রাদুর্ভাব অন্যদের তুলনায় বেশি।